সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১২

কুয়াশা ঢাকা দিন : পর্ব-১৫

পর্ব-১৫
শিশিরদের বাড়িটা পুড়িয়ে দেয়ার পর ওরা ওদের বৈঠকখানা ঘরটিতে থাকছে সেটা আগে থেকেই জানা ছিলো রবিনের। কিন্তু এতো রাতে কীভাবে শিশিরকে ডেকে ঘরের বাইরে আনবে ভেবে পাচ্ছিলো না রবিন। বাবাকে রাজাকাররা মেরে ফেলার পর শিশিরের মনের অবস্থা কী তাও জানে না সে। এই মুহূর্তে শিশির হয়তো রবিনের সঙ্গে যেতে চাইবে না। না যাক, দরকার হলে রবিন একা একাই যাবে। তবুও শিশিরকে অন্তত একবার না জানিয়ে রবিন যেতে পারে না। সেজন্যই এতো রাতে এতো কষ্ট করে আসা।
শিশিরদের বৈঠকখানা ঘরের মধ্যে এতো রাতেও টিমটিম করে আলো জ্বলছে। ওর মা নিশ্চয় জেগে আছেন। এতো রাতে ওর মা কি ওকে বাইরে আসতে দেবেন? কীভাবে শিশিরকে ডেকে আনা যায় অনেকক্ষণ ভেবে ভেবেও কোনো কূলকিনারা পেলো না রবিন। শেষে ঠিক করলো সামনের দরজায় নক করবে ও। দরকার হলে সত্য কথাই বলবে। কী আর হবে। শিশিরকে হয়তো যেতে দেবে না। না দিক, রবিনকে তো আর আটকে রাখতে পারবে না। তাহলে একা একাই যাবে রবিন।
যাওয়ার ব্যবস্থা অবশ্য করেই এসেছে ও। রবিনদের যে ডোঙ্গা নৌকাটা সব সময় ঘাটের কাছে পানির মধ্যে ডুবানো থাকে সেটাকে রেডি করে বাগানের মধ্যের নালাটায় রেখে এসেছে সে। দুটো বৈঠাও যোগাড় করে রাখা হয়েছে। দুই বৈঠা দিয়ে রবিন আর শিশির বাইতে শুরু করলে সকালের অনেক আগেই সুন্দরবনে চলে যেতে পারবে।
রবিন গিয়ে দরজায় নক করার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে দিলেন শিশিরের মা-রবিনের মাসিমা।
রবিন আর শিশিরদের মধ্যে আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ রবিনরা মুসলমান আর শিশিররা হিন্দু। কিন্তু দুই পরিবারের মধ্যে অনেক দিন থেকে এতোটাই সম্পর্ক যে মাসিমা সত্যি সত্যিই রবিনকে বোনপোর মতোই আদর করেন।
দরজা খুলেই মাসিমা বললেন, এসেছিস বাবা? কতোদিন পরে এলি! তোর জন্য রোজই সন্ধ্যাপূজার প্রসাদ রেখে দিই। কিন্তু তুই আসিস না।
বলতে বলতেই ছোট্ট পিরিচে করে চার-পাঁচটা বাতাসা আর কাঁসার গ্লাসে জল এনে রবিনের হাতে দেন তিনি।
কী করে আসবো মাসিমা, বাবা যে একদম বাইরে বেরোতে দেন না।
তাঁকে আর দোষ দিয়ে লাভ কী বাবা? দেশের যে অবস্থা তাতে কার যে কী করা উচিত বুঝতে পারছে না কেউই।
একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করলেন তিনি, আজই চলে যাবি? বাসায় সবাইকে বলে এসেছিস?
শিশিরের মায়ের প্রশ্ন শুনে আশ্চর্য হয়ে যায় রবিন। শিশির কি তাহলে সব বলে দিয়েছে? বলে দিলেও মাসিমা এতো সহজভাবে কী করে নিলেন ব্যাপারটাকে? তাহলে শিশিরকেও তিনি যেতে দেবেন? যাঁর এক ছেলে যুদ্ধে গেছে, স্বামীকে মেরে ফেলেছে রাজাকার বাহিনী, তিনি কি তাঁর বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন ছোট্ট এই বুকের ধনকে যুদ্ধে যেতে দিতে পারেন?
রবিনকে চুপ করে থাকতে দেখে মাসি আবার কথা বলে উঠলেন-ভাত বেড়ে দিচ্ছি, দুটো খেয়ে তারপর যা। শিশিরও তোর আশায় আশায় বসে আছে। জানে তুই যাওয়ার সময় ওকে নিশ্চয় সঙ্গে করে নিয়ে যাবি।
শিশির যাবে মাসিমা? অনেকটা উত্ফুল্ল হয়ে উঠলো রবিন।
যাবে না কেন বাবা, নিজের জন্মভূমির জন্য কিছু করার সুযোগ কি সবার হয়? তোদের সামনে যখন সুযোগ এসেছে, যা তোরা। যাওয়ায় দোষের কিছু নেই বাবা। তবে মনে রাখিস, ফিরে যদি আসিস কোনোদিন, তোদের হাতে যেনো বিজয়ের পতাকা শোভা পায়। শরীরে একফোঁটা রক্ত থাকতেও শত্রুকে দেখে ভয় পাস নে তোরা। আর রক্ত যদি দিতেই হয় তাহলেও মনে মনে সান্ত্বনা খুঁজে পাবি, প্রিয় জন্মভূমির মাটির সঙ্গে মিশে থাকবে তোদের রক্ত।
শিশির কোথায় মাসিমা?
পাশের রুমে। তুই খেয়ে নে, ওর সবকিছু রেডিই আছে।
এমন সময় দরজা ঠেলে রুমে ঢোকে শিশির। রবিনকে জড়িয়ে ধরে সে জিজ্ঞেস করে-এসেছিস? আমি জানতাম যে তুই আসবি। সেজন্য আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিলাম আমি।
তোরা যাবি কীভাবে, নৌকা পেয়েছিস? রবিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মাসিমা।
ভাড়া করা নৌকায় যাবো না মাসিমা। আমাদের ডোঙ্গা নৌকাটা নিয়ে যাবো।
বেশ বেশ, শরণখোলার এদিকটা নাকি পুরোপুরি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে। আমাদের রূপনগরের বেশিরভাগ ছেলে ওখানেই যুদ্ধ করছে। যারা ভারত চলে গিয়েছিলো তারাও নাকি ট্রেনিং শেষ করে ওদের সঙ্গে এসে যোগ দিচ্ছে।
একটু থেমে আবার বললেন মাসিমা, আর যে কোনো বিপদে-আপদে ধৈর্য রাখিস বাবা। ধৈর্য হারালেই মাথা কোনো কাজ করবে না। তখন বিপদ আরও বাড়বে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন