পর্ব-১৪
নৌকা
ছেড়েই গলা ছেড়ে
গান গাইতে ইচ্ছে
হলো জব্বার মাঝির। সব সময়
সে তা-ই
করে। ‘আর কতকাল
ভাসবো আমি, দুঃখের সারি গাইয়া, আমার
জনম গেল ঘাটে
ঘাটে, ভাঙ্গা তরী বাইয়া’-গানটি চমত্কার দরদ দিয়ে গাইতে
পারে জব্বার মাঝি। এর
আগে জব্বার মাঝির নৌকায়
যখন বাড়ি যেতেন
ফখরুদ্দীন খান তখন
নৌকা ছাড়ার পর
তিনিই প্রথম বলতেন
মাঝিকে-জব্বার, একটা গান
ধর তো।
জব্বার বলতো, কোন গানডা
গামু মিয়াভাই?
-গা তোর যেটা
মন চায়।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাঝি
গান ধরতো-আমার
হাড় কালা করলাম
রে, দেহ কালার
লাইগা রে, অন্তর
কালা করলাম রে
দুরন্ত পরবাসী।
এইটুকু গাওয়ার পরই থামিয়ে দিতেন খান সাহেব। থাম থাম। এটা
না। সেই গানটা
ধর।
-কোনটা মিয়াভাই?
ওই
যে, পরের বোঝা
বইয়া বইয়া, নৌকার
গলুই গেছে খইয়া-ওই গানটা।
মাঝি
তখন গানটার শুরু থেকে
শেষ পর্যন্ত একমনে গাইতো
আর আস্তে আস্তে
বৈঠা চালাতো। মাঝে মাঝে
দুয়েকবার অবশ্য চিত্কার করে বলে উঠতো-আপন বাঁয়।
আপন বাঁয় মানে
হলো নিজের বাঁয়ে। সামনে যে নৌকাটি আসছে সেটি যেনো
বাঁ দিক দিয়ে
বেয়ে আসে সেজন্যই ওই নৌকার মাঝিকে সতর্ক করে দেয়া।
আজও
নৌকায় উঠে গান
শুনতে ইচ্ছে হলো
ফখরুদ্দীন খান সাহেবের। কিন্তু মাঝিকে তিনি কিছু
বললেন না।
এতোক্ষণে রূপনগর বাজার এলাকা
ছাড়িয়েছে নৌকা। আস্তে
ধীরে কথা বললে
তেমন সমস্যা নেই। সমস্যা যা হওয়ার তা
হবে রাজাকারদের পাল্লায় পড়লে।
দীর্ঘ
সময়ের নীরবতা ভাঙলেন খান সাহেব। রবিনের মাকে বললেন
তিনি, ঘুমিয়েছো নাকি?
নৌকার
পাটাতনের উপর তোশক-চাদরের সুন্দর বিছানা করে শুয়ে
আছেন রবিনের মা। স্বামীর কথা শুনে পাশ
ফিরে শুলেন তিনি।
তারপর আস্তে করে
বললেন, না।
একটা
জিনিস আনতে ভুলে
গেছি। পাকিস্তানি বা রাজাকারদের হাতে পড়লে না
জানি কী হয়
ওটার।
কী
জিনিস?
-আমাদের পতাকাটা আনতে ভুলে
গেছি।
-না, ওটা আমি
নিয়ে এসেছি।
-কোথায় রেখেছো? পথে ওটার
জন্য বাড়তি বিপদ
হতে পারে।
-জানি। কিন্তু ওটাকে তো
আর ফেলে দিতে
পারি না। রেখেও
আসতে পারি না।
-না, ফেলে দিতে
বলছি না। কোথায়
রেখেছো তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।
-ও নিয়ে তোমার
চিন্তা করতে হবে
না।
-দেখো, কোনোরকম অপমান যেনো
না হয় ওটার।
-না হবে না।
জীবন থাকতে আমাদের পতাকার কোনো অপমান
আমি হতে দেবো
না। যে পতাকার জন্য নিজের ছেলেকে রেখে ঘর ছাড়তে
হলো সে পতাকাকে কোনোভাবেই ছোটো হতে
দিতে পারি না
আমরা।
রবিনের কথা চলে আসায়
আবারও নিশ্চুপ হয়ে গেলেন
ফখরুদ্দীন খান। ওদিকে
উজানের পথ পাড়ি
দিয়ে ভাটির টানে
তরতর করে ছুটে
চলেছে নৌকা। বৈঠা
বাওয়া বন্ধ করে
মাঝি দাঁড়ের মতো করে
ধরে রেখেছে সে বৈঠাটিকে। বৈঠাটি ডানে বাঁয়ে
ঘুরিয়ে নৌকার দিক
ঠিক রাখছে সে।
ছইয়ের
সঙ্গে একটা হুঁকো
দেখতে পেয়ে সিগারেট খাওয়ার খুব ইচ্ছে
হয় খান সাহেবের। কিন্তু সিগারেট কম খাবেন
বলে আজকাল আর
সঙ্গে রাখেন না।
আর সঙ্গে না
থাকার কারণেই হয়তোবা ইচ্ছাটা আরও বেশি
চাঙ্গা হয়ে ওঠে
তাঁর।
আস্তে
করে জব্বারকে ডাকলেন তিনি। জব্বার!
-জ্বে মিয়াভাই!
-তামাক আছে নৌকায়?
-আছে। খাইবেন আপনে?
-ধরা।
নৌকা
কি বাইন্ধা লমু মিয়াভাই? নৌকা চালাইতে চালাইতে তো আর
তামাক সাজাইতে পারমু না।
-নারে, নৌকা বাঁধার দরকার নেই। বৈঠাটা আমার হাতে দে,
আমিই দিকটা ঠিক
রাখি।
-আপনে পারবেন মিয়াভাই?
-কী যে বলিস?
পারবো না ক্যান?
দেশগ্রামের লোক আমরা।
নৌকা চালাতে চালাতে, পানিতে সাঁতার কাটতে কাটতে
বড় হয়েছি। দে, আমার
হাতে দিয়ে তুই
হুঁকাটা সাজা।
কিন্তু না, যতো সহজভাবে কথাটা বললেন খান
সাহেব ততো সহজে
হাল ধরতে পারলেন না তিনি। প্রচণ্ড স্রোত খালে। ঠিকমতো বৈঠা ধরার আগেই
নৌকাটা একটা গোত্তা খেয়ে পাড়ের একটা
ঝোপের মধ্যে ঢুকে
গিয়েছিলো প্রায়। অনেক কষ্টে
সামাল দিলেন শেষে।
পরে অবশ্য সব
ঠিক হয়ে গেলো।
অভিজ্ঞ মাঝির মতোই
হাল ধরলেন তিনি।
তরতর করে এগিয়ে
চললো নৌকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন