সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১২

কুয়াশা ঢাকা দিন : পর্ব-২০

পর্ব-২০
তুষখালী খাদ্যগুদামের তিন দিকেই নদী। আর সামনের দিকটা দিয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা চলে গেছে সোজা রূপনগর থানার দিকে। রূপনগর থেকে সাত-আট মাইল দূরে হলেও গুদামটির দিকে পাকিস্তানিদের রয়েছে কড়া নরজদারি। স্থানীয় রাজাকাররা তো আছেই, জেলা প্রশাসনের তরফ থেকেও বিশেষ খেয়াল রাখা হয় গুদামটির দিকে। তাই দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই কড়া প্রহরায় থাকে গুদামটি।
গুদামটির তিন দিক থেকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একটি দিক খোলা রাখা হয় শত্রুর পলায়নের জন্য। যেহেতু খাদ্যশস্য লুট করাই উদ্দেশ্য সেজন্য শত্রু নিধনের চেয়ে গুদামটি দখল করার দিকে গুরুত্ব দিয়েই আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়।
সন্ধ্যা থেকেই প্রস্তুতি চলছিলো মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। প্রস্তুতি যখন প্রায় চূড়ান্ত তখন ক্যাম্পে এসে হাজির হয় সুব্রত। ক্যাপ্টেনকে কী একটা খবর জানাতে এসেছিলো সে। কিন্তু রাতেই গুদাম আক্রমণ করা হবে জানতে পেরে সে আর নিজের দলের কাছে ফিরে যেতে চাইলো না। রাতে অপারেশানে অংশ নেবে সে। তারপর কাল আবার ফিরে যাবে নিজের দলের কাছে।
শিশিরকে ক্যাম্পে দেখতে পেয়েও সুব্রত তেমন কোনো আপত্তি তুললো না।
বাবার মৃত্যুর খবর আগেই জানতে পেরেছিলো সে। মা কেমন আছেন জানতে চাইলো শিশিরের কাছে।
সুব্রতের বীরত্ব আর সাহসের কথা জানা ছিলো ক্যাপ্টেনের। সুব্রত যোগ দিলে দলের শক্তি বাড়বে বলে তিনিও সায় জানালেন সুব্রতের সিদ্ধান্তে। মাঝরাতের দিকে চূড়ান্ত আক্রমণ করা হবে। ক্যাম্প পাহারায় থাকবে তিনজন। শিশির আর রবিন ক্যাম্পেই থাকবে। বাকি সবাই অপারেশানে অংশ নেবে।
পরিকল্পনাটা শিশির বা রবিন কারওই খুব ভালো লাগলো না। কিন্তু করারও তেমন কিছু নেই। এমনিতেই ওরা খুব ছোট। অস্ত্র চালানো তো দূরের কথা, কোনোদিন ছুঁয়েও দেখেনি কেউ। অবস্থায় এতো বড় একটা অপারেশানে যোগ দেয়ার প্রশ্নই আসে না তাদের।
বিকালবেলায় নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করতে লাগলো ওরা কী করা যায়। শিশির বললো, আজকের যুদ্ধে আমাদের আসলেই কিছু করার নেই। কিন্তু বসে থাকলে তো চলবে না।
তাহলে কী করবি?
আমরা পালিয়ে পালিয়ে দেখবো কেমন করে যুদ্ধ করে।
কিন্তু ক্যাপ্টেন টের পেলে আমাদের এখানে আর থাকতেই দেবেন না।
টের পাবেন না। তারা চলে যাওয়ার পর আমরা গোপনে তাদের পিছু নেবো। আবার তারা চলে আসার আগেই আমরাও ফিরে আসবো।
মাঝরাতের দিকে চূড়ান্ত অপারেশানে যায় মজনুর নেতৃত্বের দলটি।
গুদামের তিনদিকের নদী পার হয়ে আক্রমণ করতে হবে। নদী পার হওয়ায় ভয়ানক বিপদের ঝুঁকি আছে। শত্রুপক্ষের সার্চলাইটগুলো ঘুরে ঘুরে নদীর দিকে নজর রাখছে। তার মধ্য থেকেই গেরিলা কায়দায় ওপারে পৌঁছতে হবে। তারপর শত্রুসৈন্যদের সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধে তাদেরকে পরাস্ত করে গুদামের দখল নিতে হবে।
কাজে সুব্রতের কোনো জুড়ি নেই। তবে সে একা পারবে না। কারণ নদীর দিকে অন্তত তিনজন সেনা অস্ত্র তাক করে আছে। তাদের তিনজনকে একবারে ঘায়েল করতে হবে। তারপর ওদিক থেকে যদি কোনো প্রতিরোধ আসে তারও জবাব দিতে হবে।
তিনটে কচুরিপানার ঢিপির আড়ালে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে চলে শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়ে। নদী পার হয়ে প্রায় একযোগে তারা হামলে পড়ে তিনজন প্রহরীর ওপর। সহজেই কাবু হয় তারা। কিন্তু এর মধ্যেই টের পেয়ে যায় সামনের দিকের সৈন্যরা। তারাও এসে মুক্তিবাহিনীর দিকে প্রচুর গোলাগুলি নিক্ষেপ করতে থাকে।
প্রায় দুই ঘণ্টা আক্রমণ-পাল্টাআক্রমণের পর পিছু হটে শত্রুসেনারা। তাদের মধ্যে চারজন মুক্তিযোদ্ধাদের ছুড়ে মারা গ্রেনেডে সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। দুজনকে আহত অবস্থায় বন্দি করে আনা হয়। ঠিক হয় দুই পাকিস্তানি সেনাকে পরদিন মুক্ত এলাকায় এলাকাবাসীর হাতে ছেড়ে দেয়া হবে। তারাই বিচার করবে দুজনের।
দখলের পরে গুদামের সমস্ত ফটক খুলে দেয়া হয়। গ্রামবাসীদের মধ্যে অনেকে মাথায় করে সেসব খাদ্যশস্য মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে দিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের সঙ্গে হাত লাগায়। আর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে শিশির আর  রবিনও একসময় যোগ দেয় তাদের সঙ্গে।
মুক্তিবাহিনীর মধ্যে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি প্রথমে কেউ টের না পেলেও একটু পরেই সবাই জানতে পারে সুব্রতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরদিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায় খালের পাড়ে। এক পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে করতে কখন যেনো তার গায়ে একটা গুলি এসে লেগেছে। কিন্তু তারপরও সে পাকিস্তানি সেনাটাকে ছেড়ে দেয়নি। একসঙ্গেই হয়তো মারা গেছে দুজন।
সুব্রতের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁবুতে। সবাই একটা দিন মনমরা হয়ে কাটায়। শিশির একেবারেই স্তব্ধ হয়ে যায়। রবিনও তাকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো ভাষা খুঁজে পায় না।
তিন দিন পর ভয়ানক এক আক্রমণ আসে বিপক্ষ দল থেকে। জল স্থল আকাশ তিনদিক থেকেই আক্রমণ করে বসে পাকিস্তানিরা। ক্যাম্প পাহারায় থাকা তিন মুক্তিযোদ্ধা কিছু বুঝে ওঠার আগেই জল এবং স্থলপথে আক্রমণের শিকার হয় তারা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আকাশপথেও বোম্বিং শুরু হয়। হঠাত্ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধারা। সেদিন রাতের অপারেশানের পরই ক্যাপ্টেন চলে গেছেন। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলো মজনু। প্রাণপণ চেষ্টা করেও কোনোরকম কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছিলো না তারা। মাত্র গতকালই রাইফেল চালানোয় হাতেখড়ি দিয়েছিলো রবিন আর শিশির। সেই নবিস হাত দিয়ে তারাও চালাতে লাগলো অস্ত্র। শিশিরের রাইফেলের গুলিতে তিন তিনটি পাকিস্তানি সৈন্যকে পড়ে যেতে দেখলো সবাই। কিন্তু তারপরও অদম্য শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো শত্রুর দল। উপায় না দেখে সবাইকে পিছু হটতে আদেশ দিলো মজনু। কিন্তু রবিন আর শিশির তার আদেশের দিকে খেয়ালই করলো না। সমানে শত্রুর দিকে গুলি নিক্ষেপ করে চললো তারা।
চিত্কার করে বললো মজনু, শিশির, রবিন, আমি তোমাদের ক্যাপ্টেন বলছি। পেছনে ফিরে আসো তোমরা।
আদেশ শুনে গুলি চালানো বন্ধ করলো রবিন। শিশির অবস্থান নিয়েছিলো তার পাশেই। কী এক পাগলামিতে যে পেয়ে বসলো শিশিরকে তা কেউই বুঝতে পারলো না। রবিন গুলি চালানো বন্ধ করতেই মুহূর্তে শিশিরের বন্দুকের নল ঘুরে গেল রবিনের দিকে। কড়া গলায় আদেশ করলো সে, অস্ত্র হাতে তুলে নে রবিন। নইলে এখনই গুলি চালাবো।
ফিরে চল শিশির। নইলে মারা পড়বো দুজনেই। অনুনয়ের সুরে বলতে বলতেও অস্ত্র হাতে নিলো রবিন।
আবার জ্বলে উঠতে লাগলো দুজনের রাইফেলের নলের মুখ। ওদের এই প্রতিরোধে শত্রুসৈন্যরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। সামনে এগুতে সাহস পেলো না তারা। এমন সময় একটি গুলি সরাসরি এসে লাগলো শিশিরের ঘাড়ের কাছে। ঢলে পড়লো শিশির। টের পেয়ে মজনু এসে কাঁধে তুলে নিলো তাকে। অন্যদের সঙ্গে পিছু হটে নিরাপদ আস্তানায় ফিরে এলো তাকে নিয়ে।
কিন্তু না, বাঁচানো গেল না শিশিরকে। অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে মৃত্যু হলো তার।
মূলত এই আক্রমণটিই ছিলো সুন্দরবন অঞ্চলে পাকিস্তানিদের শেষ মরণ কামড়। এরপরে আস্তে আস্তে দেশ এগিয়ে যেতে থাকে স্বাধীনতার দিকে। শিশিরের মৃত্যুর পর প্রথম প্রথম রবিন কিছুটা মুষড়ে পড়লেও কয়েকদিন যেতে না যেতেই বন্ধুর শোককে শক্তিতে পরিণত করে বীরের মতো যুদ্ধ করতে থাকে সে। ষোলোই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণের পর রবিনও বাড়ি ফিরে আসে। বাড়ি এসে রবিন সবকিছু ফিরে পেলেও তার কুকুর জিমিকে ফিরে পায়নি সে। রবিনরা ওদের বাসা ছেড়ে যাওয়ার পর জিমি হয়ে ওঠে ওদের পাড়াটার একক প্রহরী। জিমি যতদিন বেঁচে ছিলো শত্রুপক্ষের একটি লোকও ঢুকতে পারেনি ওদের পাড়ায়। শেষে একদিন কে যেনো গুলি করে মারে জিমিকে। জিমি আর শিশির ছাড়া স্বাধীন দেশে রবিন স্বাধীনতার কোনো মানে খুঁজে পায় না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন