বিশাল
ধানক্ষেত। থোকা থোকা
ধানের ভারে নুয়ে
আছে ধানগাছের মাথাগুলো। সোনালি ধানের ওপর
চাঁদের আলো চিকচিক করছে। আজ পূর্ণিমা। আকাশে মেঘ নেই
একদম। তাই রাত
হলেও দিনের মতোই
সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তফাত শুধু এই,
সূর্যের আলোয় যে
প্রচণ্ড তেজ থাকে
সেটা নেই। পূর্ণিমার চাঁদের আলো নরম,
স্নিগ্ধ। মন জুড়িয়ে যায় তাতে। ধানগাছের ওপর দিয়ে দখিনা
বাতাস বয়ে যাওয়ায় সেগুলো ঢেউয়ের মতো দুলছে। দূরে, বহুদূরে দিগন্ত গিয়ে মিশেছে সবুজ বনের মাথার
ওপর। ধানক্ষেতের মাঝখানটায় একা দাঁড়িয়ে আছে একটি ককতাড়ুয়া। এতো কিছুর মধ্যেও তার মন ভালো
নেই। কারণ তার
কোনো সঙ্গী নেই।
দিনরাত একা একাই
সময় কাটাতে হয় তাকে।
এইতো
কদিন আগে এক
কৃষক তৈরি করেছে
কাকতাড়ুয়াটিকে। প্রথমে একটি লম্বা
লাঠির সঙ্গে ছোটো
একটা লাঠি আড়াআড়ি বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তারপর পুরনো একটি
জামা আর একটি
লুঙ্গি জড়ানো হয়েছে
তার সঙ্গে। লাঠির মাথায়
ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে
পুরনো একটি মাটির
পাতিল। পুরনো বলে
কালিঝুলিতে মাখামাখি হয়ে আছে
সেটা। সেই কালিঝুলির মধ্যেই সাদা চুন
দিয়ে আঁকা হয়েছে
গোল গোল দুটি
চোখ, একটা নাক
আর একটা মুখ।
ব্যস। দূর থেকে
দেখলে মনে হবে
একটা মানুষ বুঝি
দাঁড়িয়ে আছে ক্ষেতের মাঝখানে।
কাজটা
শেষ করে কৃষক
খুব খুশি হয়েছিলো। কদিন ধরে পাখিরা খুব জ্বালাচ্ছে তাকে। ক্ষেতের ধানে পাক ধরেছে। তার মধ্যে দানা
চালগুলো শক্ত হয়ে
উঠেছে। আর কদিন
পরেই কাটতে হবে।
সেসব ধান সারাদিন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে পাখির দল। কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না তাদেরকে। শেষে পুরনো জামা,
লুঙ্গি আর মাটির
পাতিল দিয়ে কাকতাড়ুয়াটা বানিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে কৃষক।
কৃষক
তো বানিয়েই খালাস। কিন্তু কাকতাড়ুয়াটা একা একা
কী করবে সারাদিন? দিনরাত একা একা
এভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যায়! কেউ
তার কাছে আসে
না। তার সাথে
কথা বলে না।
গল্প করে না।
পাখিরা দল বেঁধে
উড়ে যায় মাথার
ওপর দিয়ে। তার
কাছে একবারও আসে না।
দূরের ক্ষেতখলায় ইঁদুরেরা ধানগাছ কাটাকুটি করে নিজেদের গর্তে নিয়ে ঢোকায়। কিন্তু কাকতাড়ুয়ার কাছে কেউ
আসে না। কেউই
না।
এসব
ভেবে ভেবে মন
খারাপ হয় ককতাড়ুয়ার। সে ভাবতে থাকে
কী করা যায়।
কার সাথে বন্ধুত্ব করা যায়। কিন্তু অনেক ভেবে ভেবেও
সে কোনো বুদ্ধি খুঁজে পায় না।
কে তার বন্ধু
হবে! কার কাছে
যাবে সে!
ভাবতে
ভাবতে আনমনা হয়ে
যায় কাকতাড়ুয়া। আনমনা হয়ে
একা একাই হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে দূরে ইঁদুরদের গর্তের কাছে যায়।
ছোটো ইঁদুর আর
বড়ো ইঁদুরেরা ভীষণ ব্যস্ত তখন। দিনরাত খাবার জোগাড়
করছে তারা। সামনে
শীতকাল। শীতকালে কোথাও খাবার
খুঁজে পাওয়া যাবে
না। আর এখন
মাঠভর্তি ধান। এখন
যদি খাবার জোগাড়
করে রাখা না
যায় তবে পরে
না খেয়ে থাকতে
হবে।
কাকতাড়ুয়া হাঁটতে হাঁটতে ইঁদুরদের কাছে গিয়ে
দাঁড়ায়। প্রথমে কেউ কিছু
খেয়াল করে না।
হঠাত্ একটা ধাড়ি
ইঁদুর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পায় তাকে।
দেখতে পেয়েই ভয়ে
আঁতকে ওঠে। তারপর
গলা ফাটিয়ে চিঁ চিঁ
শব্দ করে ওঠে।
চিত্কার শুনে অন্য
ইঁদুরেরা পেছন ফিরে
তাকায়। ব্যস, এইটুকুই। তারপর সবাই যেনো
মুহূর্তে হাওয়া হয়ে
যায়। বড়ো ইঁদুর
ছোটো ইঁদুর ধাড়ি
ইঁদুর মেঠো ইঁদুর
সব গিয়ে গর্তের মধ্যে ঢোকে পলকের
মধ্যেই। বাইরে পড়ে
থাকে তাদের কেটে
রাখা ধানগাছগুলো। কাকতাড়ুয়া চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে অনেক ডাকাডাকি করে তাদের। ভয় ভাঙাবার চেষ্টা করে। কিন্তু কেউ কোনো জবাব
দেয় না।
একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার
পথে নামে কাকতাড়ুয়া।
বড়ো
ধানক্ষেতটার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে বড়ো
একটা কদমগাছ। সেই কদমগাছে চিউ চিউ করে
বড়ো পাখি আর
ছোটো পাখিরা। এখন রাত
বলে সবাই চুপচাপ। হয়তো বা নাক
ডেকে ঘুমুচ্ছে সবাই।
হাঁটতে হাঁটতে সেই গাছের
নিচে গিয়ে দাঁড়ায় কাকতাড়ুয়া। এমন সময়
একটা কাক কা
কা শব্দ করে
ডেকে ওঠে। তার
সঙ্গে গলা মিলিয়ে আরও অনেকগুলো পাখি ডানা
ঝাপটিয়ে ডাকাডাকি লাফালাফি শুরু করে
দেয়।
কাকতাড়ুয়া বলে, ভয় পেও
না পাখি বন্ধুরা, আমি তোমাদের বন্ধু হতে
এসেছি।
এ
কথায় পাখিদের কলরব আরও
বেড়ে যায়। একটা
বড়ো পাখি চেঁচিয়ে বলে ওঠে-না
না, তোমার সাথে
কোনো বন্ধুত্ব নয়। তুমি
আমাদের বন্ধু হতে
পারো না। কিছুতেই পারো না। তোমার
ভয়েই আমরা এখন
আর এই ক্ষেতের মধ্যে খেলতে পারি
না, খাবার খুঁজতে পারি না। আমরা
ভাবছিলাম ভালো একটা
আশ্রয় পেলে আমরা
এই ক্ষেত ছেড়ে,
এই গাছ ছেড়ে
চলে যাবো। তুমি
এখান থেকে চলে
যাও। আমরা কিছুতেই তোমার বন্ধু হবো
না।
কাকতাড়ুয়ার মন আরও খারাপ
হয়ে যায়। সে
আবার হাঁটতে শুরু করে।
ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে চলে
গেছে একটা পায়ে
চলার পথ। সেই
পথ ধরে হাঁটতে শুরু করে কাকতাড়ুয়া। কিছুদূর গিয়ে একটা
ব্যাঙের সঙ্গে দেখা
হয় তার। ছোটো
ছোটো লাফ দিয়ে
ছোটো ছোটো পোকামাকড় মুখ দিয়ে ধরে
ধরে খাচ্ছিলো সে। ব্যাঙকে ডেকে বললো কাকতাড়ুয়া, তুমি কি আমার
বন্ধু হবে?
ব্যাঙ
একবার পেছন ফিরে
কাকতাড়ুয়ার দিকে তাকালো। তারপর নাক সিটকিয়ে বললো, এমা, তোমার
যে ভয়ঙ্কর চেহারা তাতে শুধু
আমি কেনো, কেউই
তোমার বন্ধু হতে
চাইবে না।
এ
কথায় কাকতাড়ুয়ার মন আরও
খারাপ হয়ে গেলো।
এবার হাঁটতে হাঁটতে দূরে নদীর
পারে চলে গেলো
সে। নদীর ওপর
থেকে বয়ে আসা
ঠাণ্ডা বাতাস তার
মন জুড়িয়ে দিলো।
আকাশে
পূর্ণিমার চাঁদ তখন
অনেকটা হেলে পড়েছে। নদীর পানিতে চাঁদের আলো পড়ে
চিকচিক করে উঠছে।
ঢেউয়ের দোলায় সে
চাঁদ একবার ভেঙে
টুকরো টুকরো হয়ে
যাচ্ছে। আবার সব
টুকরোগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। নদীর ঢেউ এসে
কুলুকুলু শব্দ তুলে
পাড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। সবকিছু দেখেশুনে কাকতাড়ুয়ার মন একটু
একটু করে ভালো
হতে শুরু করলো।
দূর আকাশের চাঁদকে ডেকে সে
বললো, তুমি কি
আমার বন্ধু হবে?
চাঁদ
বললো, অবশ্যই হবো। শুধু
তুমি না, যে-ই আমার
বন্ধু হতে চাইবে
তাকেই বন্ধু করে
নেবো আমি।
কাকতাড়ুয়া বললো, তাহলে তো
ভালোই হলো। জানো,
এতোদিন আমার কোনো
বন্ধু ছিলো না।
অনেকের কাছে গেলাম,
কিন্তু কেউ আমার
বন্ধু হতে চায়
না। আজ তুমি
আমার বন্ধু হলে।
এরপর থেকে যখনই
আমার মন খারাপ
হয়ে থাকবে, তোমার
কাছে চলে আসবো।
গল্প করবো। তাহলে
মন ভালো হয়ে
যাবে আমার।
চাঁদ
বললো, খুব ভালো
কথা। কিন্তু একটা কথা
মনে রেখো। দিনের
বেলা আমাকে কোনোদিনই খুঁজে পাবে না
তুমি। কারণ আমি
থাকি পৃথিবীর অন্য পাশে।
এ পাশ থেকে
তখন তোমরা আমাকে
দেখতে পাবে না।
আজ পূর্ণিমা বলে আমাকে
পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছো তুমি। কাল থেকে
পৃথিবীর ছায়া একটু
একটু করে পড়তে
শুরু করবে আমার
ওপর। এভাবে একদিন
পৃথিবীর ছায়ায় পুরোপুরি ঢেকে যাবো আমি।
যে রাতে আমাকে
একেবারেই দেখতে পাবে
না সেই রাতটিকে সবাই বলে অমাবস্যার রাত। অমাবস্যার পরদিন আবার
আমার শরীর থেকে
একটু একটু করে
সরে যেতে থাকবে
পৃথিবীর ছায়া। তখন
আবার ধীরে ধীরে
উঁকি দিতে শুরু
করবো আমি। এভাবে
চলতে চলতে আবার
একদিন পূর্ণিমা হবে। আবার
অমাবস্যা হবে। আবার
পূর্ণিমা। আবার অমাবস্যা।
কাকতাড়ুয়া বললো, আগে তো
আমার কোনো বন্ধুই ছিল না। এখন
তুমি বন্ধু হলে।
মাঝে মাঝে যে
তোমাকে পাবো এতেই
খুশি আমি।
দুজন
কথা বলতে বলতে
প্রায় ভোর হয়ে
এলো। চাঁদ বললো,
এই যে বন্ধু,
সকাল প্রায় হয়ে
এলো। এখনই সূর্য
এসে উঁকি দেবে।
আমারও যাওয়ার সময় হলো,
এবার আমায় বিদায়
দাও।
কাকতাড়ুয়া বললো, হ্যাঁ, আমাকেও এখন যেতে হবে।
সকালবেলা কৃষক এসে
আমাকে জায়গামতো দেখতে না
পেলে চিন্তায় পড়ে যাবে।
তার আগে আমাকেও ফিরে যেতে হবে।
চাঁদ বললো, বিদায় বন্ধু, আবার দেখা হবে।
চমৎকার বর্ণনা। মনে হয় কবিতা পড়ছি। মুগ্ধ হলাম। আরও এগিয়ে যেতে হবে। অনেক- অনেক দূর। সেদিনটা পর্যন্ত যেনে বেঁচে থাকি। আমার খুব খুশি হওয়ার একটি দিন পর্যন্ত।
উত্তরমুছুন