অ-নে-ক
অনেকদিন আগের কথা
নয়। এমনকি মাত্র
কয়েক বছর আগের
কথাও নয়। একদম
এখনকার একটা গল্প
বলছি।
বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তের বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে
একটি গভীর বন
আছে। নাম তার
সুন্দরবন। সেই সুন্দরবনের একেবারেই কাছের একটি
গ্রামের নাম রূপনগর। সেই গ্রামে বাস করতো
এক বুড়ি। বুড়ির
নাম? না, বুড়ির
নাম কারও জানা
নেই। সবাই তাকে
ফুলবুড়ি নামে ডাকতো।
আর তিতলিকে তো তোমরা
চেনোই। যার ছিলো
একটি দুষ্টু পুতুল। সেই পুতুলটি সারাক্ষণ তিতলির সঙ্গে গল্প
করতো।
তো সেই তিতলি
একদিন গেলো তার
দাদাবাড়িতে বেড়াতে। আর তার
দাদাবাড়ির পাশেই ছিলো
সেই ফুলবুড়ির বাড়ি। ফুলবুড়ি আর তিতলির গল্পটা এবার তোমাদেরকে বলছি।
এ্যাই, কে ওখানে!
আমার ফুলগাছে হাত দিয়েছিস, আজ তোদের...
বলতে বলতে ঘর
থেকে বেরিয়ে এলো থুত্থুড়ে এক বুড়ি। লাঠিতে ভর দিয়ে কুঁজো
হয়ে হাঁটলেও চেহারায় তার যেনো
আগুন ঝরে পড়ছে।
দেখে তো তিতলি
থ মেরে গেলো।
তার সঙ্গীসাথীরা বুড়ির গলার
আওয়াজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উধাও। তিতলি থ
মেরে গেলো আর
কিছুটা ভয় পেয়ে
দাঁড়িয়ে রইলো যেখানে যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো ঠিক
সেভাবেই।
দাঁড়িয়ে থাকবে না-ই বা
কেনো, তিতলি তো
আর ফুলবুড়িকে চেনে না
বা তার কথা
জানেও না। মাত্র
গতকালই ঢাকা থেকে
আব্বু-আম্মুর সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে সে।
বিকালের চা-নাশতা
খাওয়ার পর তিতলির চাচাতো ভাইবোনেরা বললো, চলো
তিতলি, আমাদের পাশের বাড়িতে অনেক সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ
আছে। তুমি তো
ফুল খুব ভালোবাসো। সেখান থেকে তোমাকে অনেক অনেক ফুল
এনে দেবো।
শুনে তিতলি তো
ভীষণ খুশি। ঢাকা
শহরের শাহবাগ থেকে আব্বু
মাঝে মাঝেই ফুল
কিনে দেয় তিতলিকে, কিন্তু সেগুলো কেমন যেনো
মরা মরা, শুকনো। মনে হয় তার
কোনো প্রাণ নেই।
সেখানে ফুলগাছ থেকে ফুল
তোলা তো দূরের
কথা, ফুলগাছ দেখার ভাগ্যও অনেকের হয় না।
তিতলির দাদাবাড়ির সামনে দিয়ে
একটি ছোটো রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে
বহুদূরে। কোথায় গেছে
তা তিতলি জানে
না। সেই রাস্তা দিয়ে খানিকটা হেঁটে আরও
ছোটো একটি রাস্তা দিয়ে একটি বাড়িতে ঢুকলো ওরা। চারদিকে গাছপালার আড়াল দেওয়া
ছোট্টো একটা বাড়ি।
বাইরে থেকে বোঝা
যায় না এর
ভেতরে কী আছে।
সুপারিগাছের শুকনো পাতার
বেড়া ফাঁক করে
ওরা ঢুকলো বাড়ির
ভেতর। ঢুকে তো
তিতলির চোখ ছানাবড়া। ছোট্টো জায়গাটার ঠিক মাঝখানে আরও ছোট্টো একটি টিনের
ঘর। আর তার
চারপাশে কতো রকমের
কতো ফুলের গাছ
তা গুনে শেষ
করা যায় না।
মনে হয় ছোট্টো ঘরটিকে ঘিরে রেখেছে নানা ধরনের ফুলগাছ। সেইসব গাছের মাঝখান দিয়ে হাঁটাচলার জন্য সামান্য একচিলতে জায়গা। বাকিটা সব ফুলগাছে ভরা। আর সেসব
গাছে এতো এতো
ফুল ফুটে রয়েছে
যে দেখলে মনে
হয় কোনো গাছেই
কোনো পাতা নেই।
মানে ফুলের আড়াল
থেকে পাতারা বের হওয়ার
সুযোগই পাচ্ছে না। গোলাপ
জবা গন্ধরাজ গাঁদা ডালিয়া বেলী ছাড়াও আরও
কতো কতো ফুলের
গাছ যে সেখানে আছে তিতলি সেসব
গাছের নামও জানে
না। লাঠি হাতে
ফুলবুড়ি বেরিয়ে এসে দেখতে
পেলো তিতলি এক
দাঁড়িয়ে আছে।
দেখে বুড়ি কিছুটা আশ্চর্য হলো। কে
এই মেয়েটি? গায়ে সুন্দর ফ্রক, পায়ে জুতা
মোজা, মাথার চুলগুলো সুন্দর করে সাজানো। এ মেয়েটিকে সে কোথাও
দেখেছে বলে তো
মনে পড়ে না।
আর এতো সুন্দর কোনো মেয়ে এ
গ্রামে আছে বলেও
তো তার মনে
পড়ে না। সে
বুঝলো এ নিশ্চয়ই এ গ্রামের কোনো মেয়ে
নয়। হয়তো কারও
বাড়িতে বেড়াতে এসেছে।
বুড়ি কিছুটা শান্ত হলো।
তিতলির কাছে এসে
সে শান্তভাবে বললো, এই
মেয়ে, কী
নাম তোমার? কোথা
থেকে এসেছো?
তিতলি তার নাম-পরিচয় বললো।
বুড়ি বললো, কী
জন্য এখানে এসেছো?
কার সঙ্গে এসেছো?
তিতলি বললো, ফুলগাছ দেখতে এসেছিলাম। আমার চাচাতো ভাইয়েরা আমাকে এখানে
নিয়ে এসেছে।
বুড়ি বললো, বুঝেছি। এ নিশ্চয় রবীন আর
নবীনের কাজ। এ
গ্রামের ছেলেমেয়েগুলো খুবই পাজি।
ওরা ভীষণ জ্বালায় আমাকে। আমি একা
মানুষ। দিনরাত এইসব ফুলগাছ পাহারা দিয়ে রাখতে
হয়। তারপরও সুযোগ পেলেই
কে যে কোথা
থেকে ফুল ছিঁড়ে
নিয়ে পালায়! কেনো
বাবা মিছেমিছি আমাকে এতো
জ্বালাতন করিস তোরা!
এইসব ফুল তো
একদিন তোদের হাতেই
তুলে দেবো আমি।
তিতলি অনেক সাহস
করে বুড়িকে বললো, আমাকে
কিছু ফুল দেবে?
এ কথা শুনেই
বুড়ির মুখ একেবারে অন্যরকম হয়ে গেলো।
মনে হলো কে
যেনো একদলা কালি
এনে তার মুখে
মেখে দিয়েছে-এমন কালো
হয়ে গেলো তার
মুখটা। বুড়ি বললো,
ঠিক আছে, তোমাকে আজ আমি একটা
ফুল দিচ্ছি। কিন্তু আর যেনো
কোনোদিন ওই দস্যিগুলোর সঙ্গে ফুল চুরি
করতে এসো না।
এতোশতো ফুলের ভেতর
থেকে একটি ফুল
ছিঁড়ে দিয়ে বুড়ি
কোলে করে তিতলিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে
এলো। রাতে বাড়ি
ফিরে চাচাতো ভাইবোনগুলো তিতলিকে বললো, জানো
তিতলি আপু, বুড়িটা না ভীষণ পাজি।
ফুলগাছগুলোকে সে নিজের
জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। আর বুড়ি
ফুল এতো ভালোবাসে বলে তাকে সবাই
ফুলবুড়ি বলে ডাকে।
সারা বছর সে
ফুলগুলিকে যত্ন করে
রাখে। বুড়ির সামনে
কেউ তার ফুলগাছে হাত দেওয়া তো
দূরের কথা, তার
বাড়ির আশপাশেও ভিড়তে পারে
না। বুড়ি যদি
বোঝে যে কেউ
ফুল তুলতে তার
বাড়ির আশপাশে গেছে তাহলেই লাঠি নিয়ে তেড়ে
আসে।
একটু থেমে রবীন
বললো, তবে বছরের
দুটি দিনে অন্যরকম হয়ে যায় সে।
দিন দুটি হলো
ছাব্বিশে মার্চ আর
ষোলোই ডিসেম্বর। তিতলি আপু,
তুমি তো কয়েকদিন আছো আমাদের বাড়িতে। ছাব্বিশে মার্চের তো মাত্র
কয়েকদিন বাকি। সেই
দিন দেখো অন্যরকম এক বুড়িকে দেখবে।
দেখতে দেখতে ছাব্বিশে মার্চ এসে গেলো।
সেদিন খুব সকাল
সকালই রবীন আর
নবীন তিতলিকে নিয়ে গেলো
বুড়ির বাড়িতে। গিয়ে তিতলির চোখ তো ছানাবড়া। মনে হয় সারা
গ্রামের সব ছেলেমেয়ে বুড়ির বাড়িতে হাজির হয়েছে। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের হইচই আর কলাকাকলিতে অন্যরকম এক পরিবেশ হয়েছে সেখানে।
বুড়ি নিজের হাতে
সব গাছের ফুল
যত্ন করে একটা
একটা করে তুললো। বড় একটা চাদরের ওপর সব ফুল
তুলে রাখলো সে।
তারপর মুঠি মুঠি
সেগুলো তুলে দিলো
সব ছেলেমেয়ের হাতে। সবাই
ফুল নিয়ে লাইন
ধরে বাড়ির সামনের রাস্তাটি দিয়ে এগিয়ে
চললো। একদৃষ্টিতে তাদের চলে
যাওয়ার পথের দিকে
তাকিয়ে রইলো বুড়ি।
সবার সঙ্গে সঙ্গে
তিতলিও ফুল নিয়ে
এগিয়ে চললো।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা
স্কুলঘরের সামনে গিয়ে
পৌঁছলো। স্কুলঘরের সামনে বিরাট
একটি মাঠ। সেই
মাঠের এককোণে একটি শহীদ
মিনার।
শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে
ওরা সব ফুল
ছিটিয়ে দিলো সেখানে। ওদের দেওয়া ফুলে
ফুলে ছেয়ে গেলো
পুরোটা মিনার।
রাতে দাদুকে বুড়ির আশ্চর্য সব কাণ্ডকারখানার কথা বললো
তিতলি।
দাদু বললো, বুড়ির
চালচলনে তোমরা তাকে
পাগল ভাবতে পারো।
তাকে যদি কেউ
না চেনে বা
তার কথা না
জানে তাহলে তা-ই ভাববে। কিন্তু ফুলবুড়ির জীবনটা আসলে খুবই
দুঃখের। এই দুনিয়ায় তার আপন বলতে
কেউ নেই।
এই পর্যন্ত বলে দাদু
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর আবার
বলতে শুরু করলেন। বুড়ির একটি ছেলে
ছিলো। আমরা ছেলেটাকে চিনতাম। সে ছিলো
খুবই বুদ্ধিমান। আর ভালো
ছেলে হিসেবেও তার খুব
সুনাম ছিলো। এই
গ্রামের প্রতিটি লোকের বিপদে-আপদে ছেলেটি এগিয়ে আসতো।
তাদের ছিলো অনেক
কষ্টের সংসার। আয়রোজগার করার মতো
তেমন কেউ তাদের
ছিলো না। বুড়ি
মানুষের বাড়ি বাড়ি
কাজ করে যা
পেতো তাই দিয়ে
ছেলেকে কোনোরকমে খাইয়ে পরিয়ে
বাঁচাতো। ছেলেটি বুড়িকে অনেক আশার
কথা শোনাতো। লেখাপড়া করে সে
অনেক বড়ো হবে,
তখন আর তাদের
কোনো দুঃখ থাকবে
না, এ রকম
কথা সারাক্ষণই বুড়িকে বলতো ছেলেটি। ছেলেটি ছিলো লেখাপড়ায়ও খুবই ভালো। আর
ফুল খুব ভালোবাসতো সে।
একদিন হলো কী,
আমাদের দেশে একটা
যুদ্ধ শুরু হলো।
সেটা ছিলো উনিশশো একাত্তর সাল। তখন
বাংলাদেশ আর পাকিস্তান একই দেশ। এক
দেশ হওয়ার পরও
পাকিস্তানিরা আমাদেরকে সবকিছুতেই ঠকাতো। এতে এ
দেশের লোকজন গেলো
ক্ষেপে। তারা স্বাধীনতা চাইলো। আর তাই
পাকিস্তানিরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের মানে এ
দেশের মানুষদের সঙ্গে যুদ্ধ
শুরু করে দিলো।
তো বুড়ির সেই
ছেলেটিও তখন আরও
অনেকের সঙ্গে যুদ্ধে গেলো।
নয় মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু বুড়ির ছেলেটি আর ফিরে
এলো না। সবাই
বললো, অনেক সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে
করতে ছেলেটি মারা গেছে।
সেই থেকে বুড়ি
সারা বছর ধরে
ফুলগাছ লাগায় আর
ফুলগাছের পরিচর্যা করে। আর
বছরের দুটি দিনে
মানে ছাব্বিশে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবসে আর
ষোলোই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে
সেই ফুল সব
ছেলেমেয়েকে দিয়ে দেয়
শহীদ মিনারে দেওয়ার জন্য। বুড়ি
মনে করে শহীদ
মিনারে ফুল দিলে
তা তার ছেলেটি পাবে। আর এতে
ছেলেটি খুব খুশি
হবে।
এসব কথা শুনতে
শুনতে তিতলির চোখ দিয়ে
কখন যে জল
গড়িয়ে পড়তে শুরু
করেছে সে নিজেই
বলতে পারবে না।
তবু তিতলি ভাবলো,
সে নিজেও তো
আজ শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে এসেছে। সেই ফুল পেয়ে
ছেলেটি হয়তো খুব
বেশি হয়েছে।
“অ-নে-ক অনেকদিন আগের কথা নয়। এমনকি মাত্র কয়েক বছর আগের কথাও নয়। একদম এখনকার একটা গল্প বলছি।.... “ চমৎকার সূচনা। এর আগে এমন দেখিনি। এই গল্পটার কাহিনীর কথা বাদ দিয়ে বলতেই হয়, অন্যান্য গল্পের চেয়ে এই গল্পটি বলার স্টাইল ও সাবলীল প্রবহমান গদ্য ছন্দের বর্ণনা চমৎকার।
উত্তরমুছুনএ ধরনের মন্তব্য যে-কারও মন ভালো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তার ওপর সেটা যদি হয় বোদ্ধা কোনো লেখক বা পাঠকের তাহলে তো কথাই নেই। তাই মন্তব্য পড়ে আমারও মন ভালো হয়ে গেল। তবে কাহিনীর কথা বাদ না রেখে ভালো-মন্দ দিকনির্দেশ করলে ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সহজ হতো।
মুছুন