সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১২

কুয়াশা ঢাকা দিন : পর্ব-৮

পর্ব-
১৯৬৪ সালে শিশিররা একবার ভারতে চলে গিয়েছিলো। চলে গিয়েছিলো না বলে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলো বলা যায়। সেবার হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে বিরাট এক দাঙ্গা হয়। হিন্দুরা মুসলমানকে আর মুসলমানরা হিন্দু কাউকে নিজের এলাকায় পেলে জবাই করে ফেলতো। তখন নিরাপত্তার জন্য পশ্চিমবাংলার মুসলমানরা পূর্ববাংলায় এবং পূর্ববাংলার হিন্দুরা পশ্চিমবাংলায় চলে যায়। নামে পূর্ব পশ্চিমবাংলা হলেও দুটি অঞ্চলের একটি পাকিস্তানের অংশ, অন্যটি ভারতের।
শিশিরদের পাড়ায় একমাত্র হিন্দু গেরস্ত ছিলো ওরাই। হলে কী হবে, ওদের পাড়ার বিশ-পঁচিশ ঘর গেরস্তের মধ্যে সম্পর্ক এতোই ভালো ছিলো যে প্রথম প্রথম দেশ ছাড়ার কথা চিন্তাই করতো না ওরা। এছাড়া পড়শীরা সবাই ওদের অভয় দিতো। বলতো, সারা দেশে যা হয় হোক গিয়ে, আমাদের পাড়ায় রায়ট বা দাঙ্গা এরকম কিছু হবে না।
কিন্তু দিনে দিনে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে সেই পড়শীরাই একসময় শিশিরের বাবাকে বলতে শুরু করে, দাদা, দেশের যে অবস্থা, কখন কী হয় বলা তো যায় না, একটু সাবধানে চলবেন।
এজন্য অবশ্য তাদরকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। অবস্থা দিনে দিনে আসলেই ভয়াবহ আকার নিয়েছিলো।
শিশিরের বাবা সেদিনও তেমন একটা ভয় পেলেন না। কিন্তু ঘাবড়ালেন সেদিন যেদিন অন্য পাড়ার কয়েকটি যুবকের সঙ্গে পাড়ার যুবকদের প্রায় মারামারি লেগে গেলো।
শিশিরদের পাড়ায় ঢোকার মুখেই একটি ক্লাব ঘর। সেই ক্লাবের রঞ্জু হঠাত্ করেই পাড়ার সব যুবককে খবর দিলো। সালাউদ্দিন, বাদল, রফিক, মঞ্জু-সবাই এসে হাজির হলো রঞ্জুর তলব পেয়ে। সবাইকে ডেকে রঞ্জু কিছুটা ভাষণ দেওয়ার মতো করেই বলেছিলো, সারা দেশে দাঙ্গা যতোই ছড়াক না কেন, আমাদের পাড়ার শান্তি যেনো কোনোভাবেই নষ্ট না হয়। মাত্র একটি হিন্দু পরিবার পাড়ায়। তাদের যেনো কোনো ক্ষতি না হয়।
রঞ্জুর কথা শুনে রফিক বলেছিলো, তোর কি মনে হয় তাদের ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা আছে?
আছে বলেই তো তোদেরকে সাবধান করলাম।
কিন্তু সবকিছু খুলে না বললে আমরা বুঝবো কীভাবে? আর আগে থেকে প্রস্তুত না থাকলে তাদেরকে বাঁচাবোই বা কীভাবে?
শোন, দুদিন ধরে খেয়াল করছি আশপাশের পাড়ার বখাটে কিছু ছেলে আমাদের পাড়ার এদিকে ঘোরাঘুরি করছে। দেখেশুনে ওদের মতলব ভালো মনে হচ্ছে না। তাই আমাদের আগেই সাবধান হতে হবে।
ওরা যখন এসব নিয়ে আলোচনা করছিলো তখনই খালপাড়ের পাশের রাস্তায় সাত-আট যুবকের দিকে চোখ পড়লো ওদের। রঞ্জু বললো, ওই দেখ ওরা আবার এসেছে।
সালাউদ্দিন বললো, একটা কাজ করলে হয় না! ওদের ডেকে জিজ্ঞেস করি কেনো এদিকে ঘোরাঘুরি করছে।
কিন্তু ওরা তো ভালো ছেলে না। কিছু জিজ্ঞেস করলেই ঝামেলা বাধাবে।
তাই বলে চুপ করে বসে থাকলেও তো শান্তিতে থাকতে পারবো না আমরা। শান্তিতে থাকতে দেবে না ওরা।
ওদের মধ্যে বাদল সব সময়ই কথা কম বলে। কিন্তু প্রচণ্ড সাহসী আর বদমেজাজী বলে তার নাম আছে। হঠাত্ করে সে একটা কাণ্ড করে বসলো। খালপাড়ের দিকে তাকিয়ে চিত্কার করে উঠলো---, তোরা এপাড়ায় এসে ঘুরঘুর করছিস কেন?
বলার সঙ্গে সঙ্গে যুবকদের পুরো দলটা পেছন ফিরে চাইলো।
দলের মধ্যে নেতা গোছের একটি ছেলে এগিয়ে এলো সামনে। পেছনে ঘুরে গেল পুরো দলটা।
কী বলতে চাস?
বাদল আর বসে থাকতে পারলো না। দাঁড়িয়ে আবারও চিত্কার করে বললো-বলছি, নিজেদের পাড়া রেখে পাড়ায় ঘুরঘুর করছিস যে?
কেবল তো ঘুরঘুরই করছি, আসল খেল্ তো এখনও দেখাইনি।
খেল্ দেখাবি মানে? কী খেল্ দেখাবি তুই? আক্রমণের ভঙ্গিতে কিছুটা সামনে এগিয়ে যায় বাদল। সালাহউদ্দিন বাধা দেয় তাকে।
সেটা সময় হলেই দেখবি। তবে তোদের সাবধান করে দিচ্ছি শত্রুদের প্রতি বেশি দরদ দেখাতে যাস নে, শেষে নিজেরাই বিপদে পড়বি। অবস্থা বুঝতে পেরে বিপক্ষ দলও কিছুটা পেছন হটে।
তোদেরকেও সাবধান করে দিচ্ছি আমি, পাড়ায় আমরা যারা থাকি সবাই আমরা বন্ধু, কোনো শত্রু নেই। আগ বাড়িয়ে ফাজলামি করতে আসবি তো হাড্ডি গুঁড়ো করে দেবো।
তোদের মুরোদ কত আছে সে দেখা যাবে সময় হলেই।
গজরাতে গজরাতে চলে গিয়েছিলো যুবকদের দলটি।
রাতেই সব খবর পৌঁছে গিয়েছিলো শিশিরের বাবার কানে। শোনার পর এক মুহূর্ত দেরি করতে রাজি হননি শিশিরের বাবা। বাড়ির সমস্ত মালামাল মেম্বার সাবের ঘরে তুলে দিয়ে, জায়গা-জমির মায়া ছেড়েছুড়ে রাতেই দেশ ছেড়েছিলেন।
কিছুদিন পর অবশ্য সব আবার স্বাভাবিক হয়ে এসেছিলো। ফিরে এসেছিলেন শিশিরের বাবা পরিবার নিয়ে।
ভাগ্য ভালো তার। ফিরে এসে সব মাল-জিনিসই যেমনটা ছিলো তেমন অবস্থায় ফেরত পেয়েছিলেন। মেম্বার সাবের বউ সবকিছুই নিজের মতো করে আগলে রেখেছিলেন। কাঁসা পিতলের হাঁড়ি পাতিল পেয়ালা বাটিগুলো পুকুরের পানির মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। আর সোনা রুপার অলঙ্কার রেখেছিলেন মাটিচাপা দিয়ে।
শিশিরদের পরিবার ফিরে আসায় তিনি যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সবকিছু ফিরিয়ে দিলেন তিনি।
সব ফিরে পেয়ে শিশিরের মা তো ভীষণ খুশি। রবিনের মাকে বলেছিলেন তিনি, দিদি আপনিই শুধু এতো কিছু হাতে পেয়েও আবার ফিরিয়ে দিলেন। অন্য কেউ হলে দিতো না।
তা অন্য লোকজন ফেরত দেবে কী, অনেকেই বরং সুযোগ পেয়ে তখন হিন্দুদের সবকিছু লুট করেছে সে কথা রবিনের মাও জানতো। তবু বললো, আরে না, আর এমন কী, আপনাদের বিপদের সময় কিছুটা হলেও যে আপনাদের উপকার করতে পেরেছি এটাই তো অনেক কিছু।
শিশির অবশ্য তখন বেশ ছোটো। তবে তার স্পষ্ট মনে আছে এসব কথা। মানুষের বিচিত্র চরিত্রের কথা ভাবছিলো আর আশ্চর্য হচ্ছিলো শিশির। একই দেশের একই আবহাওয়ার এমনকি একই জাতির মানুষ হয়েও মানসিকতায় কত তফাত থাকতে পারে মানুষের মধ্যে। যে যুবক ছেলেগুলোর কোনো ক্ষতি না করার পরও শিশিরের বাবা তাদের শত্রু-তাদের এক চরিত্র। যে একুশ ঘর পরিবার নিজেদের বিপদের কথা চিন্তা না করে শিশিরদের আগলে রাখতে চাইছিলো-তাদের এক চরিত্র। আর যারা শুধু শুধুই শিশিরের বাবার মতো একজন নিরীহ মানুষকে গুলি করে মারলো-তাদের এক চরিত্র। তারপরও শিশির ভেবে দেখলো, এই পৃথিবীতে এখনও ভালো মানুষদের সংখ্যাই বেশি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন