সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১২

কুয়াশা ঢাকা দিন : পর্ব-১৯

পর্ব-১৯
ক্যাম্পে ফিরেই শিশির আর রবিনকে কাছে ডাকলেন ক্যাপ্টেন।
-নৌকা নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলে তোমরা দুজন?
-মাঝের চরে। উত্তর দিলো রবিন।
-সেখানে কী জন্য যাচ্ছিলে?
-মুক্তিযুদ্ধ করবো আমরা। শুনেছি মাঝের চরে মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটি গেড়েছে।
-কোত্থেকে এসেছো তোমরা?
-রূপনগর থেকে।
-রূপনগর কোন বাড়ি তোমাদের?
-খান বাড়ি।
-খান বাড়ি! একটু যেনো চমকালেন ক্যাপ্টেন।
-তোমার বাবার নাম?
-ফখরুদ্দীন খান।
ফখরুদ্দীন খান তোর বাবা? আয় আমার কাছে আয়। রবিনকে হাত উঁচিয়ে কাছে ডাকলেন ক্যাপ্টেন।
হঠাত্ করেই তুমি থেকে তুই- নেমে গেলেন ক্যাপ্টেন। তার আচরণে রবিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলো।
-তাইতো বলি এতোটুকু ছেলের এতো সাহস হয় কী করে! এখন বুঝলাম আমার ভাগ্নের সাহস থাকবে না তো কার থাকবে?
ক্যাপ্টেনের কথায় বিস্ময়ের মাত্রা আরও বেড়ে গেলো রবিনের। মায়ের মুখে শুনেছে রবিন-মায়ের এক চাচাতো ভাই একজন সাব-সেক্টর কমান্ডার। কিন্তু এই লোকই কি সেই? কমান্ডার হলে তো তাঁর যুদ্ধ করার কথা।
-আচ্ছা তোর মা কেমন আছে? কোথায় আছে সে?
-গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার কথা ছিলো কাল রাতে। হয়তো চলে গেছে।
-তার মানে না বলে এসেছিস তোরা। আজ তো ছোটখাটো একটা যুদ্ধ দেখলি, কী মনে হচ্ছে পারবি যুদ্ধ করতে?
-পারবো।
এবার শিশিরকে কাছে ডাকলেন ক্যাপ্টেন।
-তোমার বাবার নাম কী?
-অরুণ হালদার।
-অরুণ বাবুর ছেলে? ওনাকে তো রাজাকাররা মেরে ফেলেছে, তাই না?
-হ্যাঁ। উত্তর দিয়ে নিচের দিকে চোখ রেখে চুপ করে রইলো শিশির।
-সুব্রত কোথায় আছে জানো?
এবার শিশিরের অবাক হওয়ার পালা। এই লোকটি দেখছি দুনিয়ার সব খবরই রাখেন। কে ইনি?
শিশিরকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার কথা বললেন ক্যাপ্টেন। বললেন, বলছি সুব্রত কোথায় আছে, কী করছে, তোমার মা কি জানেন?
-না, জানেন না। শুধু জানেন যে দাদা কোথাও যুদ্ধ করছেন।
-তুমিও তো পালিয়ে এসেছো তাই না?
-না।
-তবে? তোমার মা তোমাকে এই অবস্থার মধ্যেও আসতে দিলেন?
-এমনিতেও আমরা খুব ভালো অবস্থায় ছিলাম না। আপনি তো সবই জানেন। বাবাকে মেরে ফেললো ওরা। বাড়িঘর সব লুটপাট করলো, জ্বালিয়ে দিলো। এর চেয়ে খারাপ অবস্থা আর কী হতে পারে?
-এখন কী করতে চাও?
-আমরা যুদ্ধ করবো। নিচের দিকে তাকিয়ে থেকেই উত্তর দিলো শিশির।
-আরে বোকা, এতো উতলা হচ্ছো কেন, আমরা আছি না! আমরাই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করবো। তোমাদের মতো বাচ্চাদের জীবন নিয়ে খেলার দরকার নেই। এক কাজ করো। গোসল খাওয়াদাওয়া করে রেস্ট নাও। আজ রাতে আমাদের কিছু লোক যাবে রূপনগরের দিকে। ওদের সঙ্গে বাড়ি চলে যাও। যুদ্ধ করার জন্য শুধু সাহস থাকলেই হয় না, শক্তিও দরকার।
রবিন বললো, আমরা ফিরে যাবো না মামা। আমাদেরকে আপনাদের দলে নিয়ে নিন।
-আচ্ছা নিয়ে নিলাম। তবে সম্মুখযুদ্ধে যেতে পারবে না তোমরা। এই ক্যাম্পেই থাকবে। ক্যাম্পে অনেক ধরনের কাজ থাকে। সেগুলো করবে তোমরা।
শিশির আর রবিন মনে মনে ভাবলো, সে দেখা যাবে, আগে দলে জায়গা করে নিতে পারলে হয়।
ওদের কথার মাঝখানেই মজনু এসে হাজির হলো। এসেই ক্যাপ্টেনকে একটা স্যালুট করলো। মুখে বললো, কেমন দেখলেন ক্যাপ্টেন আমাদের অভিযান?
-শাব্বাশ। আরে এভাবেই তো দেশ স্বাধীন হবে।
-শিগগিরই আরেকটা অপারেশান চালাতে হবে। খুবই জরুরি অপারেশান। ক্যাম্পে চাল ডাল কিচ্ছু নেই। গ্রামের লোকজন অনেক কষ্ট করে, এমনকি নিজেরা না খেয়ে থেকে আমাদের সাহায্য করছে। কিন্তু এভাবে আর চলছে না।
-কী করতে চাও? জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।
নদীর ওপারে সরকারি খাদ্যগুদাম ভর্তি চাল। অবশ্য কড়া পাহারায় রাখা হয়েছে গুদামটা। তারপরও আমরা সাকসেস হবো বলে আশা করছি।
-ঠিক আছে। তবে এবারে কিন্তু আমি পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পারবো না। অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করবো আমিও।
-না লিডার। আমরা বেঁচে থাকতে এইসব ছোটখাটো কাজে আপনাকে রিস্ক নিতে দেবো না আমরা। এই অপারেশানটাও আপনি শুধু দেখবেন। যা করার আমরাই করবো।
-বেশ করো। তবে খেয়াল রেখো, অকারণে যেনো আমাদের শক্তিক্ষয় না হয়। যুদ্ধের এখনও অনেক বাকি। যতোদিন বিজয় না আসে ততোদিন লড়াই চালিয়ে যেতে হবে আমাদের।
-আপনি নিয়ে ভাববেন না।
এবার রবিন আর শিশিরের দিকে চোখ ফেরালো মজনু। ওদের প্রসঙ্গ আসবে বুঝতে পেরে ক্যাপ্টেন নিজে থেকেই বলতে শুরু করলেন-ওরা দুজন তোমাদের খোঁজেই মাঝের চরের দিকে যাচ্ছিলো। যুদ্ধ করবে ওরা। অনেক চেষ্টা করেও ফেরাতে পারলাম না। কী আর করা। ক্যাম্পে রেখে দাও ওদের। কাজে লাগবে।
-কোত্থেকে এসেছে ওরা?
-রূপনগর থেকে। বলতে ভুলে গেছি, রবিনটা হচ্ছে আমার এক বোনের ছেলে। ওর মাকে ছোটোবেলা থেকেই অনেক জ্বালিয়েছি আমি। ওর মা তার আপন ভাইদের চেয়েও আমাকে কেনো যেনো একটু বেশি ভালোবাসে। আর ছোটোবেলা থেকেই সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছি আমি। দেশ স্বাধীন হোক, তোমাদের সবাইকে নিয়ে যাবো বুবুর বাড়িতে। দেখবে কী আপ্যায়নটাই করে বুবু।
এবার শিশিরের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। আর হচ্ছে সুব্রতের ভাই শিশির। তোমরা তো জানোই, শরণখোলার ওদিকটায় যে কটি ছেলে সাহস আর বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধে করছে তাদের মধ্যে সুব্রতও একজন।
মজনু একজন লোক ডেকে শিশির আর রবিনকে দেখিয়ে বললেন, ওদের নাশতার ব্যবস্থা করো। আমি পরে ওদের সঙ্গে কথা বলবো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন