পর্ব-১৮
খুলনা
থেকে পটুয়াখালীর দিকে পাকিস্তানিদের বিশাল এক বহর
যাওয়ার কথা রয়েছে
আজ রাতেই। ওদিকে বেশ
কয়েকটা ছোটখাটো অপারেশনে জয়ী হওয়ার
পর সুন্দরবন এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল এখন
তুঙ্গে। তার ওপরে
দুদিন আগে ভারত
থেকে ট্রেনিং শেষ করে
বড় একটি দল
তাদের সঙ্গে যোগ
দিয়েছে। সন্ধ্যারাত থেকেই নদীর
দুই পাড়ে অপেক্ষায় আছে মুক্তিযোদ্ধারা। আজকের অপারেশনের নেতৃত্ব দেয়ার ভার
পড়েছে মজনুর ওপর।
পুরো
দলটাকে চারভাগে ভাগ করে
অবস্থান নেয়া হয়েছে। মজনু নিজে আছে
পুব পারে। খুলনার দিক থেকে পাকবাহিনীর নৌবহর এলে পুব
দিক থেকেই আগে
চোখে পড়ার কথা।
যেহেতু আজকের অপারেশনের কমান্ডার পুব পারে
তাই পুব পার
থেকে আগে আক্রমণ শুরু করা হবে
বলে ঠিক করা
হয়েছে।
নদীর
একেবারে পাড় ঘেঁষে
বিভিন্ন শেল্টারে অবস্থান নিয়ে আছে
মুক্তিযোদ্ধারা। কমান্ডার মজনু রয়েছে
একটু পেছনে।
পুব
আকাশ তখন ফর্সা
হয়ে উঠেছে। চোখের সীমানায় যা কিছু পড়ছে
সবই প্রায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। এমন সময়
ডান দিকে দূর
থেকে অস্পষ্ট একটা ইঞ্জিনের আওয়াজ ভেসে আসতে
থাকায় সবাই সজাগ
হয়ে উঠলো। দূরবীণের আইপিসে বারবার চোখ রেখে
এদিক ওদিক লক্ষ
রাখছিলো কমান্ডার মজনু।
ডানদিক থেকে পাকিস্তানিদের আসার কথা
থাকলেও কমান্ডার তার চোখ
ঘুরাচ্ছিলো চারদিকেই। চারদিকে ভালো করে
খেয়াল করতেই তার
চোখের সামনে একটা
ছোট ডোঙা নৌকা
ভেসে উঠলো। দুই
কিশোর তাড়াহুড়া করে চালাচ্ছিলো নৌকাটি।
বেশ
একটা সমস্যায় পড়লো কমান্ডার। ডানদিক থেকে ভেসে
আসা শব্দটা যদি সত্যি
সত্যিই পাকিস্তানি বাহিনীর নৌযানের শব্দ হয়
তাহলে মূল আক্রমণ যখন শুরু হবে
তখন কিশোর দুটি
থাকবে তাদের টার্গেটের আশপাশেই। ওদেরকে বাঁচাতে হলে এখনই
থামাতে হবে ওদের।
হামিদ অবস্থান নিয়েছিলো মজনুর খুব
কাছাকাছি একটা জায়গায়। ইশারায় তাকে কাছে
ডাকলো মজনু।
কী
খবর কমান্ডার? কিছু দেখতে
পাইতাছেন?
না,
এখনও দেখা যাচ্ছে না। তবে খুব
তাড়াতাড়িই এসে পড়বে।
তাড়াতাড়ি একটা কাজ
করতে হবে তোমাকে। রূপনগরের ওদিকের খালের মুখে
একটা নৌকা দেখা
যাচ্ছে। যে করেই
হোক ওদেরকে ফেরাতে হবে। নইলে
গোলাগুলির মধ্যে পড়ে
যাবে নৌকাটি। যাও, যেমন
করেই হোক ফিরাও
ওদেরকে।
নির্দেশ পেয়ে ছুটে চললো
হামিদ। কিন্তু ততোক্ষণে নৌকাটা পাড় থেকে
বেশ খানিকটা দূরে সরে
গেছে। চিত্কার করে ডাকলেও শুনতে পাবে না
ওরা। এক মুহূর্ত চিন্তা করলো হামিদ। তারপর কোমরের লাল গামছা
খুলে পতাকার মতো দোলাতে লাগলো।
হঠাত্ই সেটা খেয়াল করলো
শিশির। এই রবিন,
দেখ তো নদীর
পারে লাল কী
একটা দোলাচ্ছে কেউ একজন।
তাইতো। কী হতে পারে
ওটা বল তো?
সম্ভবত কোনো সঙ্কেত দিচ্ছে কেউ।
নদীতে
আমাদেরটা ছাড়া অন্য
কোনো নৌকা নেই।
নিশ্চয় আমাদেরকে কোনো সঙ্কেত দিচ্ছে।
আমারও
তাই মনে হচ্ছে।
দূরে
একটা ইঞ্জিনের শব্দ শোনা
যাচ্ছে না?
হ্যাঁ।
কী
করা যায় বল
তো?
আমার
মনে হয় সঙ্কেতটার দিকে যাওয়া উচিত
আমাদের। কারণ এ
অঞ্চলটা পুরোটাই এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে।
তাই আমাদের মনে হয়
সঙ্কেতটাকে অনুসরণ করাই উচিত।
আমারও
তাই মনে হয়।
সঙ্গে
সঙ্গে ঘুরে গেল
নৌকার মাথাটা। কিশোর দুটো
সঙ্কেত বুঝতে পেরেছে মনে করে হামিদও তার শার্টটা নামিয়ে ফেললো। কারণ পাকিস্তানিদের নৌবহর বাঁদিকে মোড় নিলে
তাদের চোখেও পড়ে
যাবে সঙ্কেত। তাতে পুরো
বাহিনীটাই বিপদের মধ্যে পড়বে।
খুব
বেশি সময় লাগলো
না নৌকাটাকে পাড়ে আনতে
রবিন আর শিশিরের। ততোক্ষণে অবশ্য অস্থির হয়ে উঠেছিলো হামিদ। নৌকার মাথাটা পাড়ে ভিড়তেই সেটাকে টেনে ধরলো
সে।
তাড়াতাড়ি কূলে ওঠো। ওদিকে
কোথায় যাচ্ছ?
বলতে
না বলতেই লাফিয়ে পাড়ে উঠলো দুজন।
শিশির জিজ্ঞেস করলো, আপনি
কে?
আমি
একজন মুক্তিযোদ্ধা। আরেকটু হলেই বিপদে
পড়তে যাচ্ছিলে তোমরা। এসো আমার
সঙ্গে। বলেই দৌড়াতে শুরু করলো হামিদ। পেছন পেছন রবিন
আর শিশিরও দৌড়াতে লাগলো। নিজের শেল্টারের কাছাকাছি গিয়ে পেছনের দিকে ইঙ্গিত করলো হামিদ-দৌড়ে ওই
বেড়িবাঁধের ওপাশে যাও।
একটু পরেই গোলাগুলি শুরু হবে। অপারেশান শেষ না হওয়া
পর্যন্ত ওখানেই থাকবে তোমরা। তাছাড়া ওখানে আমাদের এ অঞ্চলের কমান্ডার জিয়াভাই আছেন। তোমাদের কী করতে হবে
তিনি তোমাদের বলে দেবেন।
কথা
শেষ করেই হামিদ
ওদেরকে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলো। সঙ্গে
সঙ্গেই রবিন আর
শিশির ওয়াপদার বেড়িবাঁধের ওদিকটায় দৌড় শুরু
করলো।
আজকের
অপারেশানে নেতৃত্ব দেয়ার কথা
ছিলো সুন্দরবন অঞ্চলের কমান্ডার জিয়াউদ্দিনের। কিন্তু মজনু তাঁকে
আসতে দেয়নি। এ এলাকার ছোটখাটো অপারেশানের নেতৃত্ব এর আগে
মজনুই দিয়েছে কিন্তু আজকের অপারেশানের গুরুত্ব বিবেচনা করে জিয়াউদ্দিন নিজেই নেতৃত্ব দিতে চাইছিলেন। কিন্তু মজনু বলেছে,
বস, যুদ্ধটা আমরাই করি।
আপনি শুধু দূর
থেকে দেখেন আমাদের পরিকল্পনায় কেমন কাজ
হয়।
অন্যসব মুক্তিযোদ্ধাও মজনুকে সাপোর্ট করে। কী
আর করা! কমান্ডার জিয়াউদ্দিন একটা দূরবীণ নিয়ে অপারেশান এলাকা থেকে
একটু দূরে বেড়িবাঁধের পেছনে ওদের প্রস্তুতির দিকে খেয়াল রাখছিলেন।
হামিদ
যখন তার শেল্টার ছেড়ে দৌড়ে নদীর
পাড়ে যাচ্ছিলো তখন থেকেই
ওদের দিকে লক্ষ
রাখছিলেন তিনি। তাঁর
কাছাকাছি ওরা দুজন
পৌঁছতেই হাত ইশারায় ডাকলেন। কাছে যেতেই
বললেন, তোমাদের সঙ্গে পরে
কথা হবে। এখন
চুপচাপ আমার পেছনে
বসে থাকো। একটু
পরেই গোলাগুলি শুরু হবে।
ভয় পাওয়ার কোনো কারণ
নেই। আমরা পাকিস্তানিদের নাগালের অনেক বাইরে। এ পর্যন্ত আসার আগেই
ওদের খেল্ খতম
হয়ে যাবে।
তিনটি
স্পিডবোট এসকর্ট করে নিয়ে
যাচ্ছিলো দুটি লঞ্চকে। বহরটা চোখে পড়তেই
চার জায়গায় অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধারাই সতর্ক হয়ে কমান্ডারের নির্দেশের অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু সবাইকে অবাক করে
দিয়ে প্রথম ফায়ারিং শুরু করা হয়
লঞ্চ দুটো থেকেই। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ওরা আগেই
টের পেয়ে গিয়েছিলো বোধহয়।
কিন্তু সামান্য একটু ভুল
হয়ে গিয়েছিলো পাকিস্তানিদের। তাদের বহরের
সামনাসামনি দূরের চরটার
দিকে গোলাগুলি নিক্ষেপ করতে করতে
এগুচ্ছিলো তারা। এদিকে
নদীর দুই পারে
অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে
হয়তো তাদের কোনো
ধারণা ছিলো না।
হঠাত্ নদীর দুই
পার থেকে যখন
আক্রমণ শুরু হলো
তখন তারা একেবারেই দিশেহারা হয়ে গেল।
তিনদিক থেকে আক্রমণের মুখে স্পিডবোট তিনটি শুরুতেই ধ্বংস হয়ে গেল।
লঞ্চ দুটো থেকে
কিছুটা প্রতিরোধের চেষ্টা করেও কোনো
লাভ হলো না।
লঞ্চের ডেকেই ঢলে
পড়লো কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। কয়েকজন লাফিয়ে পড়লো পানিতে। কিন্তু সাঁতার না জানার
কারণে অল্প সময়েই
পানিতে তলিয়ে গেল
তারা।
সেদিনকার অপারেশানে মুক্তিযোদ্ধাদের সামান্য ক্ষয়ক্ষতিও হয়নি। বরং
প্রচুর গোলাগুলি তারা পায়
লঞ্চ দুটোতে। এতোবড় একটি
বিজয় এতো সামান্য চেষ্টায় সফল হয়েছে
দেখে জিয়াউদ্দিনও খুশি হন
তাঁর বাহিনীর ওপর। পিঠ
চাপড়ে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে সবাইকে নিয়ে ক্যাম্পে ফেরেন তিনি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন