ভোররাতে হঠাত্ করেই রান্নাঘর থেকে একটা চিত্কার কানে আসে আসমা বেগমের। পাশে ব্যবসায়ী স্বামী আশরাফ সাহেব নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। আসমা বেগম উঠে দরজা খুলে রান্নাঘরের দিকে এগোন। সুইচ টিপে বাতি জ্বালিয়ে দেখেন এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে বছর পনেরো বয়সের কাজের মেয়ে বৃষ্টি। বৃষ্টি কালই এসেছে দেশ থেকে। একটা মাত্র ছুটা কাজের বুয়া আর একটা কাজের লোক দিয়ে চার জনের সংসারের সব কাজ ঠিকঠাকমতো করাতে পারেন না আশরাফ সাহেব। তার ডাকের সাথে সাথেই যাতে দু-চারজন ছুটে আসে সেজন্য আরও দুজন লোক রাখবেন বলে মনে করছেন তিনি। তা ছাড়া বেশি বেশি কাজের মানুষ না থাকলে আত্মীয়-মেহমানদের কাছে নিজের স্ট্যাটাস বজায় থাকে না। স্ত্রী আসমা বেগম অবশ্য বাধা দিয়েছিলেন-কী দরকার এই ছোট সংসারটায় বেশি বেশি কাজের লোক রেখে ঝামেলা বাড়ানোর!
বৃষ্টির চোখমুখ দেখেই কিছু একটা আঁচ করতে পারেন আসমা বেগম। কী রে, কী হয়েছে-জিজ্ঞেস করে উত্তরের অপেক্ষায় না থেকেই বলেন, দরজার সিটকিনিটা ভালো করে বন্ধ করে শোও। কোনো অসুবিধা হলে আমাকে ডাকিস। আমার রুমের দরজা খোলাই রইলো।
ড্রইংরুম পেরিয়ে একমাত্র ছেলে সাগরের রুমের দিকে পা বাড়ান আসমা বেগম। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই সিগারেটের কড়া গন্ধে বমি আসতে চায় তার। কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে সাগর। সাগর যে ঘুমের ভান করে আছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না আসমা বেগমের। কী একটা ছোট জিনিস পায়ে লেগে খুঁট করে আওয়াজ হতেই অন্ধকারে হাতড়ে সেটাকে হাতে তুলে নেন তিনি। জিনিসটা হাতে নিয়ে বুঝতে পেরে ঘৃণায় রি রি করে ওঠে তাঁর শরীর। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে নিজের রুমে ফিরে আসেন আসমা বেগম।
দিন পনেরো কেটে যায়। প্রথম রাতের ঘটনাটা ভুলতে না পারলেও নিজেকে অনেকটা নিরাপদ মনে করতে থাকে বৃষ্টি। বিশেষ করে আসমা বেগম ওর প্রতি বিশেষভাবে নজর রাখছেন বলে আর কোনো ঝামেলায় পড়তে হবে না মনে করে আশ্বস্ত হয় ও।
এরই মধ্যে আশরাফ চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি থেকে খবর আসে তার বৃদ্ধ মা অসুস্থ। ব্যবসার ব্যস্ততার জন্য তিনি নিজে যেতে পারছেন না। তাই বাধ্য হয়ে আসমা বেগমকেই যেতে হয়। একা যেতে অসুবিধা হবে বলে সাগরকে সঙ্গে নিয়ে যান তিনি। বাবার বয়সী চৌধুরী সাহেবকে দেখাশোনার ভার পড়ে বৃষ্টির ওপর।
শোবার আগে বৃষ্টিকে এক গ্লাস পানি দিতে বলেন আশরাফ চৌধুরী। এক ঘণ্টা পর তার রুম থেকে বৃষ্টি যখন ফিরে আসে তখন তার সমস্ত গা ব্যথায় টনটন করছে। ঘৃণায় গালাগাল দিতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারছে না।
বাকি রাতটা আর ঘুম আসে না ওর। ফজরের আজান পড়তেই কাপড়চোপড়ের ছোট পোঁটলাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। রাস্তায় লোকজন নেই তেমন। যে দুয়েকজনের দেখা পাওয়া যায় তাদের কাছে জিজ্ঞেস করে করে কমলাপুরের দিকে হাঁটতে থাকে বৃষ্টি। দিনাজপুরের ট্রেনটা ধরতে হবে। ওটা নাকি খুব সকালেই ছেড়ে যায়।
দিনাজপুর পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে যায়। একদিকে গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, অন্যদিকে ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। পরশু দুপুরের পর থেকে পেটে কিছু পড়েনি। এমনকি এক গ্লাস পানিও না। হাঁটতে গিয়ে পা দুটো টলতে থাকে তার। এমন সময় সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে তিনটি লোক। তিনজনকে দেখতে প্রায় একই রকম মনে হয় বৃষ্টির।
ভাদ্র মাসের কোনো এক বৃষ্টির দিনে জন্ম হয়েছিল বলে মা আদর করে নাম রেখেছিলেন বৃষ্টি। সেই ভাদ্র মাসেই মায়ের কাছে ফিরে যাচ্ছে ও। মায়ের সেই চির দুঃখী দুঃখী মুখটা চোখের সামনে ভাসতে থাকে বৃষ্টির। লোক তিনটা বলে, চলো, আমাদের গাড়ি আছে। গাড়িতে করেই তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। তাহলে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারবে।
অন্য কিছু ভাববার মতো অবস্থা ছিল না বৃষ্টির। আর এত রাতে অন্য কোনো উপায়ও নেই। এই নির্জন স্টেশনে রাত কাটাবারও সাহস হয় না। বিশেষ করে গত রাতের কথা মনে করে। সেই দুঃসহ সময়টার কথা মনে হতেই গায়ের ব্যথাটা নতুন করে মাথাচাড়া দেয়। অগত্যা কোনো প্রতিবাদ না করে অন্ধকারের মধ্যে লোক তিনটিকে নিঃশব্দে অনুসরণ করতে থাকে সে। বৃষ্টির ক্লান্ত-অবসন্ন-ক্ষুধার্ত চোখ দেখতে ব্যর্থ হয় তিনজোড়া চোখের উপচে পড়া লালসা।
*
* *
নাইট ডিউটি করে বাড়ি ফিরছিল স্টেশনের লাইনম্যান রহিম আলী। তিন রাস্তার মোড়ে আসতেই সে দেখতে পায়, একটা মেয়ের ছিন্নভিন্ন বিকৃত মৃতদেহ পড়ে আছে রাস্তার পাশে। তার পাশে জমে উঠেছে কৌতূহলী মানুষের ভিড়।
ভিড়ের মধ্যে রহিম আলীর গা ঘেমে ওঠে। ঘোরের মধ্যে সে দেখে তার সবুজ বাতি দেখানো ট্রেনলাইন থেকে কারা যেন লাইন তুলে ফেলেছে অন্ধকারে। তার স্বপ্নের গন্তব্যমুখী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে থ্যাঁতলানো মাংসপিণ্ড আর রক্তনদীতে হাবুডুবু খাচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন