সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১২

কুয়াশা ঢাকা দিন : পর্ব-১১

পর্ব-১১
সন্ধ্যারাতেই খোঁজ পড়ে রবিনের। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। সন্ধ্যায় নাকি তাকে দেখা গেছে ওদের টিনের দোতলা ঘরের ওপরতলায় শুয়ে থাকতে। কিন্তু সন্ধ্যার পর বা রাতে তাকে দেখেছে এমন সাক্ষ্য কেউ দিলো না। রবিনের বাবাসহ সবাই পড়লো মহা মুশকিলে। কিছুক্ষণ পরেই গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা দেবে সবাই। এখানে আর একটা দিন থাকাও নিরাপদ মনে হচ্ছে না। প্রতিদিনই নতুন নতুন সব অঘটন ঘটছে ছোট্ট এই মফস্বল শহরটিতে। অবস্থায় হঠাত্ করেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না রবিনকে। কী হতে পারে, কোথায় যেতে পারে অতোটুকু ছেলে-কেউই ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারলো না।
এমন সময় রবিনের ছোটোবোন মিতু দৌড়ে এলো। মা, বাবা, পেয়েছি। এই যে দেখো ভাইয়ার লেখা চিঠি।
চিঠিটা তাড়াতাড়ি হাতে তুলে নিলেন ফখরুদ্দীন খান। নিয়ে প্রথমে জোরে জোরে পড়তে লাগলেন :
মা-বাবা,
আমি চলে যাচ্ছি। দেশের এই দুঃসময়ে ছাড়া আমার কিছুই করার ছিলো না। জানি তোমরা খুব দুঃখ পাবে। তবুও আমি নিরুপায়। নিজেদের দিকে, মিতুর দিকে খেয়াল রেখো। আমাকে খুঁজো না। খুঁজলে জানাজানি হবে। তাতে তোমাদের ওপর বিপদ নেমে আসতে পারে। তার চেয়ে আজ রাতেই গ্রামের বাড়িতে চলে যাও। যদি বেঁচে থাকি তবে আবার মাথা উঁচু করে সবাই বাড়িতে ফিরে আসবো। আর যদি বেঁচে না থাকি তবেও দুঃখ কোরো না। দেশের জন্য রক্ত দেয়ার সৌভাগ্য সবার হয় না। আমাদের যখন হয়েছে তখন সুযোগ কাজে লাগানো উচিত।...
পর্যন্ত পড়েই চেঁচিয়ে উঠলেন ফখরুদ্দীন সাহেব। শাবাশ, এই তো সোনার দেশের সোনার ছেলের মতো কথা।
পাশ থেকে মিতু বলে উঠলো-বাবা ভাইয়া ফিরে আসবে তো?
অবশ্যই আসবে। ওরা কতজনকে মারবে বল? সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ওরা মেরে ফেলতে পারবে না নিশ্চয়। দেখিস, রবিনরা একদিন বিজয়ের গর্ব নিয়ে ফিরে আসবেই আসবে।
বলতে বলতে চোখের পাতা ভিজে এলো ফখরুদ্দীন খানের। তার চোখে ভেসে উঠলো ছোট্ট এক রবিনের মুখ। হাফপ্যান্ট পরে বই-স্লেট বগলে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো ছোট্ট রবিন। বাবাকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লো। -স্কুলে যাচ্ছি বাবা।
-যা। কিছু বলবি?
-দশটা পয়সা দেবে বাবা?
-কেন, পয়সা দিয়ে কী করবি?
-আমাদের ক্লাসের ইউসুফকে দেবো। পয়সার অভাবে খাতা কিনতে পারে না।
-কেন, ওর বাবা খাতা কিনে দেয় না?
-দেয় না তো। ওর বাবা রিকশা চালায় তো, খাতা কিনতে পারে না। ওরা অনেক গরিব বাবা। টেনে টেনে বলে রবিন।
-তুই জানলি কী করে?
আমাকে সব বলে ও। জানো না বাবা, তো আমার বন্ধু।
এতো কথা বলার পর ছেলের হাতে দস্তার তৈরি দুটো দশপয়সা তুলে দেন ফখরুদ্দীন খান। এই যে, ওকে দশ পয়সা দিস  আর বাকিটা দিয়ে টিফিন কিনে খাস।
আট-বছর আগের ঘটনাটির ছবি স্পষ্ট ভেসে ওঠে খান সাহেবের চোখের সামনে। মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। সেই ছোট্ট রবিন আজ যুদ্ধে যাওয়ার সাহস করেছে, ভাবতেই বুকটা যেনো গর্বে ভরে ওঠে রবিনের বাবার। ডান হাত দিয়ে দুই চোখের কোল মোছেন তিনি। সবকিছুর পর তার চেহারায় একটা স্নিগ্ধ ভাব ঝিলিক দিয়ে ওঠে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন