পর্ব-২
রবিনদের স্কুলের পেছন দিকটায় ঘোষেদের বিশাল বাগান। বাগানের পাশ দিয়ে
বয়ে গেছে বলেশ্বরের শাখা নদী। নামে
নদী হলেও এটি
আসলে একটি খালের
মতোই। খালটির দুপাড়কে জোড়া লাগিয়েছে বড় একটি লোহার
ব্রিজ। ব্রিজের একদিকে নৌকাঘাট। অন্যদিকে স্কুল।
ঘাটে
তখন বেশ কয়েকটি কেরায়া নৌকা বাঁধা। মাঝিরা কেউ খালে
নাইতে নেমেছে। কেউবা ছোট্ট
মাটির চুলায় করে
দুপুরের খাবার রান্না করছে। একজন ছইয়ের
মধ্যে বসে বসে
কুড়ুত্ কুড়ুত্ শব্দ করে
হুঁকো টানছে।
স্কুল
ছুটির পর শিশির
এসে বসেছে স্কুলের পেছনের বাগানের ঠিক খালের
পাড়টায়। তার কাছাকাছি খালের দুপারে খেলছে অনেকগুলো বাচ্চা ছেলে। দুটো
দলে ভাগ হয়েছে
তারা। ভাগ হয়ে
খালের দুই পারে
অবস্থান নিয়েছে দুই দল।
দুই দলের সবার
মধ্যেই যুদ্ধের সাজ। গাছের
ছোট ছোট ডাল,
মাটির ঢেলা, এক
ধরনের ছোট ছোট
বুনো ফল-এসবই
অস্ত্র দুদলের। বাঁশের কঞ্চি কেটে
চমত্কার এক অস্ত্র বানিয়েছে ওরা। তার
মধ্যে ছোট্ট এক
ধরনের বুনো ফল
ভরে অন্য একটা
লাঠি দিয়ে বিশেষ
কায়দায় ছুড়ে মারা
হয় ফলগুলো। একদলের যুদ্ধজাহাজ একটা তালগাছের ডোঙ্গা নৌকা। অন্যদলের কলাগাছের ভেলা। একদল
অন্যদলকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে ডোঙ্গা নৌকায় অথবা
ভেলায় চড়ে। বিপক্ষ দল তখন তাদেরকে ফিরানোর জন্য নিজেদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োগ করছে। মজার
ব্যাপার হলো-দুদলই
দুদলকে পশ্চিম পাকিস্তানি বলে আক্রমণ করছে।
এইমাত্র এপারের দলটি হামলা
চালিয়ে ওপার থেকে
একটি বাচ্চা ছেলেকে ধরে এনেছে। ধরে এনে মিছেমিছি তাকে মারছে আর
বলছে, পশ্চিমা সৈন্য ধরে
এনেছি, মার, সবাই
মিলে ওকে মার।
অন্যদিকে বন্দি ছেলেটি বলছে, আমি পশ্চিমা না, আমি বাঙালি। দেশের জন্য যুদ্ধ
করছি আমি। মরে
গেলেও তোদের মতো
পশ্চিমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবো না। এ
দেশ আমরা স্বাধীন করবোই। এই বলে
ছেলেটি একদলা থুতু
ছিটিয়ে দেয় মাটিতে।
শিশির
বসে ছিলো খালের
পাড়ে একটা গাছের
গুঁড়ির ওপর।
কাছে
কোথাও একটা ঘুঘু
তখন একটানা ডেকে চলছিলো। দখিনা বাতাসে গাছের পাতারা থরথর করে কাঁপছিলো। একটা মাছরাঙা পাখি খালের
পাড়ে ছোট্ট একটা
গাছের ডালে বসে
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পানির
দিকে। মাছের দেখা
পেলেই পানিতে ঠোকর দিয়ে
ঠোঁটে তুলে আনবে
মাছ।
রবিন
এলো ঠিক চল্লিশ মিনিট পর। এসেই
বললো, স্যরি দোস্ত,
দেরি হয়ে গেলো।
আমি মনে করলাম
তুই আবার অপেক্ষা টপেক্ষা করে চলে
গেলি কি না।
শিশির
বললো, না রে,
তোর অর্থনীতি ক্লাসটার কথা আমার
জানা ছিলো। আমার
অর্থনীতি নেই বলে
এক ঘণ্টা আগেই
ছুটি পেয়ে গেলাম।
কী
করছিলি এতোক্ষণ বসে বসে?
যুদ্ধ
দেখছিলাম।
মানে!
খালের
দুপারে বাচ্চাগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলো শিশির। ওই যে
দেখ, দুদলের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। একদল
আরেক দলকে প্রাণপণ আক্রমণ করছে। জীবন
বাজি রেখে সে
আক্রমণ প্রতিরোধ করছে অন্যদল।
ওদের
কথার মাঝখানেই দূর থেকে
বিকট একটা শব্দ
ওদের দিকে এগিয়ে
আসতে থাকে। কয়েক
সেকেন্ডের মধ্যেই সেটা ওদেরকে অতিক্রম করে দূরে
কোথাও মিলিয়ে যায়।
ওই
যে যাচ্ছে, পশ্চিমা দালালের বাচ্চা সব। ছুটন্ত স্পিডবোটের দিকে ইশারা
করে বললো শিশির।
হ্যাঁ,
থানায় যাচ্ছে। কোথাও মুক্তির খোঁজটোজ করতে গিয়েছিলো হয়তো। মুক্তি মানে বোঝো
তো?
হ্যাঁ,
বুঝবো না কেন,
মুক্তিবাহিনীর লোকদের ওরা মুক্তি বলে ডাকে। শোন
যেজন্য ডেকেছিলাম।
হ্যাঁ
বল।
তুই
কি কিছু ভেবেছিস?
কী
ভাববো বল তো?
ওই
যে পণ্ডিত স্যার যে
ইঙ্গিত দিলেন।
কই
স্যার তো কোনো
ইঙ্গিত টিঙ্গিত দেননি।
দিয়েছেন। নইলে বাংলার ক্লাসে হঠাত্ করেই
পণ্ডিত স্যার ভূগোল
পড়াতে গেলেন কেন?
আমি
পিছনের বেঞ্চের ছাত্র। স্যারদের নিয়ে অতশত
চিন্তা আমার নেই।
ওসব করবে তোর
মতো ভালো ছাত্ররা। বললো রবিন।
শিশির
বললো, শোন দোস্ত,
তুই তো জানিস,
সুন্দরবনে মুক্তিবাহিনী আশ্রয় নিয়েছে। আমরা যদি কেউ
পালিয়ে যাই তাহলে
যাতে পথ ভুল
না করি সেজন্যই স্যার আমাদেরকে ম্যাপ এঁকে
পথঘাট চিনিয়ে দিলেন।
শিশিরের কথা শুনে এক
মুহূর্ত চুপ করে
থাকলো রবিন। তারপর
বললো, শিশির, আমি
যা করবো তা
মনে মনে আগেই
ঠিক করে রেখেছি। তবে তুই এসব
নিয়ে মাথা ঘামাস
নে। বাড়ি গিয়ে
লেখাপড়া কর। সামনে
পরীক্ষা, তোকে ফার্স্ট হতে হবে না!
না
রে, দেশের এই
অবস্থায় কেউই নিজেকে নিয়ে আর ভাবছে
না। সবাই দেশ
নিয়ে চিন্তা করছে। দেশের
ভবিষ্যত্ নিয়ে চিন্তা করছে। সবার মাথায়
একটাই চিন্তা-কীভাবে ঢাকায় ছাত্রদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। রাজারবাগ পুলিশলাইনে কী নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়েছে। কীভাবে হত্যা করা
হয়েছে নিরীহ মানুষদের। শোন, আমি জানি
এ অবস্থায় তুই নিশ্চয় বসে থাকবি না।
তাই তোকে এখানে
ডেকে এনেছি। এখন থেকে
আমরা যা করবো
দুজনে একসঙ্গেই করবো।
পালাবি? জিজ্ঞেস করেই সোজা
শিশিরের চোখের দিকে
তাকিয়ে থাকে রবিন।
শিশিরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো রবিনের চোখের দিকে। তারপর
ডান হাত বাড়িয়ে দিলো। রবিন ডান
হাত দিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরলো শিশিরের হাত। ছোট্ট সে
মুষ্টিতে কী ভয়ঙ্কর তেজ তা টের
পেলো শুধু শিশিরই।
হাত
ছাড়িয়ে নিয়ে শিশির
বললো, এই রবিন,
তোর গুলতিটা কই? তুই
তো রোজই গুলতি
নিয়ে এই বাগানে পাখি শিকার করে
বেড়াস। চল আমরা
পাখি শিকার করে
হাত সই করি।
নারে
দোস্ত, তুই আসলে
আমাকে ভুল বুঝেছিস। আমি গুলতি হাতে
নিয়ে এই বাগানে ঘুরে বেড়াই ঠিকই,
তবে সেটা পাখি
শিকার করার জন্য
নয়, দুষ্ট ছেলেদের হাত থেকে পাখিদের বাঁচাতে। দুষ্ট ছেলেরা পাখির বাসা ভেঙে
ফেলে, বাসা থেকে
ডিম পেড়ে নেয়,
বাচ্চা পাখিদের ধরে নিয়ে
খাঁচায় আটকে রাখে।
এইসব দুষ্ট ছেলেকে ভয় দেখানোর জন্যই গুলতিটা হাতে রাখি আমি।
পাখি আছে বলেই
তো এই বন,
এই গাছপালা এতো ভালো
লাগে। তাই না
শিশির!
হ্যাঁ
তাই। চল তাহলে,
আজ বাসায় ফিরে
যাই।
হ্যাঁ চল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন