সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১২

কুয়াশা ঢাকা দিন : পর্ব -১৩

পর্ব -১৩
বাড়ি থেকে পালিয়ে রবিন প্রথমেই গেলো শিশিরের খোঁজে।
রবিনদের বাসার পিছনে বিশাল এক বাগান। লোকে বলে কালিদাসের বাগান। বিশাল বড়ো বড়ো সব গাছপালায় ভরা সে বাগান। এই বাগানেরই দক্ষিণ দিকে রবিনদের বাসা। আর একেবারে উত্তর প্রান্তে শিশিরদের। রাতের বেলা বাগানের মধ্যে গা ছমছম করা ভয়।
কিন্তু ভয় পেলে তো চলবে না রবিনের। তাছাড়া সামনের দিকে বাজারের মধ্যের রাস্তা দিয়েও এতো রাতে চলাচল করা যাবে না। রূপনগর বাজার এখন পুরোপুরিই পাকিস্তানিদের দখলে। সঙ্গে আছে রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির লোকজন। কিন্তু গ্রামগুলো স্থানীয়দের দখলে।
স্থানীয়রা মানে মুক্তিযোদ্ধারা নয়, গ্রামের লোকজন স্বেচ্ছায় নিজেদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে পাহারা দিচ্ছে গ্রাম। তবে তাদের শক্তি খুব একটা বেশি নয়। রাজাকারদের সঙ্গে যুদ্ধে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা জয়ী হচ্ছে কিন্তু থানা শহর থেকে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী যখন আক্রমণ করছে, স্থানীয়রা তখন -ঢাকা দিচ্ছে। অবশ্য গা-ঢাকা দিয়ে নিজেদের গা বাঁচাতে পারলেও সহায়সম্পদ, বাড়িঘর বাঁচাতে পারছে না। তাদেরকে না পেয়ে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানিরা। আবার মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো গ্রুপ যখন তাদের সঙ্গে যোগ দেয় তখন তারা হয় অপরাজেয় শক্তি। তখন তাদের সঙ্গে পেরে উঠবে এমন শক্তি পাকিস্তানিদের নেই।
এসব কথা মনে করতে করতে হাঁটছিলো রবিন। এমন সময় কাছেই কোনো একটা পাখি ডানা ঝাপটে উঠলো। হঠাত্ ডানা ঝাপটানোর শব্দে প্রথমে একটু কেঁপে উঠলো রবিন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার মনোবল ফিরে এলো তার। যে ছেলে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে, দেশকে স্বাধীন করতে রওনা হয়েছে তার কি ভয় পাওয়া চলে? রবিনও এরপরে আর ভয় পাবে না বলে ঠিক করলো। কী হবে মিছেমিছি ভয় পেয়ে! মানুষের জীবনে মৃত্যু তো খুব স্বাভাবিক ঘটনা, যাকে এড়ানোর কোনোই উপায় নেই। আর দেশের এই অবস্থায় তো মৃত্যু কোনো ঘটনাই নয়। একজন, দুজন, তিনজন, চারজন কিংবা পাঁচ দশজন মানুষের মৃত্যুকেও মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করছে। রাজাকার বা পাকিস্তানিদের হাতে দু-দশজন মানুষের মৃত্যু কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানিদের-সবই স্বাভাবিক ঘটনা।
হাঁটতে হাঁটতে বাগানের মাঝামাঝি জায়গাটায় এসে পৌঁছেছে রবিন। জায়গাটায় একটি বড়ো পুকুর। পুকুরের একদিকে বড়ো একটি বাঁধানো ঘাটলা। যদিও বাগানে দিনের বেলায়ও খুব একটা লোকজন আসে না, তারপরও এই নির্জন জায়গায় শান বাঁধানো ঘাটলা থাকার মানে বোঝে না রবিন।
এলাকার লোকজনের মুখে মুখে এই পুকুরটি নিয়ে নানা ধরনের গল্প শোনা যায়। এই পুকুরে নাকি কয়েক হাজার বছর বয়সের একটি শোল বা গজার মাছ আছে। মাছটি নাকি এতোই বড় যে একটি বড়োসড়ো মানুষ তার পিঠে উঠে দিব্যি বসে থাকতে পারে। মাছটির গায়ে নাকি নানান রংয়ের আলপনা আঁকা। পূর্ণিমার রাতে মাছটি পানির ওপর ভেসে আসে বলে বিশ্বাস করে এলাকার লোকজন। তখন যদি মাছটির কাছে কোনো কিছু চাওয়া যায় তবে মাছটি তা দিয়ে দেয় মানুষকে।
গাছপালার ছায়ার জন্য পুরো বাগানটিই অন্ধকার হলেও পুকুর এবং ঘাটলার বেশিরভাগ জায়গায়ই ফকফকে জোছনা। জোছনামাখা পুকুরঘাটটা এতোই ভালো লাগলো রবিনের যে সে গিয়ে ঘাটলায় বসলো। ঘাট সোজা পুকুরের ওপারেও একটা ঝাঁকড়া দেবদারু গাছ। তার মাশেই অন্য কী একটা গাছ রবিন তা চিনতে পারে না। সারা বাগানে কোনো জোনাক পোকা দেখেনি রবিন কিন্তু পুকুরপাড়ের সেই অচেনা গাছটায় ঝাঁক ঝাঁকে জোনাক পোকা দেখতে পেলো সে। জোনাক পোকার জ্বলা নেভা দেখে রবিন আজ নতুন করে অবাক হলো। হাজার হাজার জোনাক পোকা একই সঙ্গে, একই তালে জ্বলছে আর নিভছে। যখন সব জোনাক পোকা একসঙ্গে জ্বলে উঠছে তখন অদ্ভুত রকমের সুন্দর দেখাচ্ছে গাছটা।
জোনাক পোকার আরেক নাম নাকি আঁধার মানিক।
রবিনদের গ্রামের নামও আঁধার মানিক। ওরা অবশ্য দুটোকেই আন্ধার মানিক বলে থাকে। বরিশাল অঞ্চলের মানুষদের অবশ্য এটাই স্বভাব। চন্দ্রবিন্দুটাকে তারা পুরো একটা দন্ত্য বানিয়ে ফেলে। তারা আঁধারকে আন্ধার, বাঁদরকে বান্দর, চাঁদকে চান্দ, বাঁধাকে বান্ধা, রাঁধাকে রান্ধা বলে। তাই আঁধার মানিক তাদের মুখে আন্ধার মানিক হয়ে যায়।
জোছনা রাত দেখে রবিনের মনে হলো আজ হয়তো পূর্ণিমা। তাহলে তো আজ রাতেই ভেসে উঠবে আজব সেই মাছটি। মাছটির খোঁজে পুকুরের চারদিকে চোখ ফেরালো রবিন। না, কোথাও নেই। আজব মাছটিকে পেলে রবিন কী চাইবে? মনে মনে এক মুহূর্ত ভাবলো সে। কী চাওয়ার আছে তার মুহূর্তে!
যুদ্ধের কারণে মানুষের ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। অনেক ভেবে দেখলো রবিন, মুহূর্তে দেশের স্বাধীনতা ছাড়া তার চাওয়ার আর কিছুই নেই। একটি মাছ কি তার চাওয়ার প্রতিদান দিতে পারবে?
পারবে না। কারণ বড়ো কঠিন জিনিস। স্বাধীনতা কেউ কাউকে হাতে তুলে দেয় না। তাকে আদায় করে নিতে হয়। অর্জন কর নিতে হয়। যে করেই হোক স্বাধীনতা চাই-মনে মনে বললো রবিন। এরপর আবার উঠে হাঁটতে শুরু করলো শিশিরদের বাসার দিকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন