সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১২

কুয়াশা ঢাকা দিন : পর্ব-১৬

পর্ব-১৬
ভোরের আলো উঠি উঠি করছিলো। খালপাড়ের গাছে গাছে পাখিরা সকাল হওয়ার আনন্দে, কিচির মিচির শুরু করে দিয়েছে। অদূরে গ্রামের কোনো মসজিদে বেসুরো গলায় আজান দিচ্ছেন বয়সী কোনো মুয়াজ্জিন। জব্বার মাঝি তখনও বেয়ে চলেছে নৌকা। শেষরাত্তিরে বারানির খালে কচুরিপানার জন্য নৌকা নিয়ে এগুতে পারেনি মাঝি। নইলে এতোক্ষণে খান বাড়ি পৌঁছে যেতো সে।
সামনে আর একটা গ্রাম। তারপরই বড়ো খাল ছেড়ে ডান দিকের ছোটো খালটি ধরে সামান্য সামনে এগুলেই ফখরুদ্দীন খানদের বাড়ির ঘাট।
সারারাত না ঘুমানোর পরে শেষরাতের দিকে সামান্য ঘুম ঘুম পাচ্ছিলো খান সাহেবের। তাই স্ত্রীর পাশের বালিশটিতে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিলেন তিনি। ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। কিন্তু হঠাত্ যেনো কার বিকট আওয়াজের ডাকচিত্কারে ঘুম ভেঙে যায় তাঁর।
ওই মাঝি, কেডা যায় নাওয়ে? খালের অদূরে ওয়াপদার রাস্তা থেকে চিত্কার করে জানতে চাইলো কে একজন।
খান বাড়ির লোক। মাঝিও চিত্কার করেই উত্তর দিলো।
কোন খান? আইছে কোত্থিকা?
আন্ধারমানিক গ্রামের ইয়াজউদ্দিন খান বাড়ির লোক।
কোন খান? নাম কী?
ইয়াজউদ্দিন খানের নাতি ফখরুদ্দীন খান। রূপনগর গেছিলো ডাক্তার দেহাইতে।
নাও থামাও।
নাও থামান যাইবে না, নাওয়ে মাইয়া ছেইলা আছে।
থামাইতে হইবেই। কমান্ডার সাব চেক করবে হ্যারপর যাইবে নৌকা।
চেক করা লাগবে না। এই নাওয়ে খারাপ কিছু নাই। খারাপ কোনো লোকজনও নাই।
মাঝির উত্তরে মাথা গরম হয়ে যায় এস্কান্দার হাওলাদারের। রাজাকার কমান্ডার সোনাই মিয়ার ডানহাত সে। গ্রামের সবাই তাকে জল্লাদ এস্কান্দার নামে চেনে। নিজেকে প্রচণ্ড সাহসী হিসেবে পরিচয় দেয়ার জন্য শুধু জল্লাদের কাজই না, যতো ধরনের অপকর্ম আছে সবই সে করতে পারে।
মাঝির ওপর রেগে গিয়ে সে আরও জোরে চিত্কার করে ওঠে। ভালো মন্দের তুমি কি বোঝো? নাও থামাও। নইলে গুল্লি চালাইয়া সব ঝাঁঝরা কইরা ফালামু, আমার নাম এস্কান্দার হাওলাদার।
নৌকা থামাতে বলার সঙ্গে সঙ্গেই ছইয়ের মধ্যে উঠে বসেছিলেন ফখরুদ্দীন খান। প্রথম ধাক্কায় মনের মধ্যে একটু আতঙ্ক এসে ভর করলেও একটু পরেই সাহস ফিরে আসে তাঁর বুকে। দেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধে গেছে যার ছেলে সে কিনা এই ঘৃণ্য রাজাকার ব্যাটাকে ভয় পাবে? কিছুতেই না। মাঝি আর রাজাকারটির কথা শুনতে শুনতে সে ভাবতে লাগলো, দেখা যাক কী হয়।
এমন সময় সেই চূড়ান্ত নির্দেশ আসে পাড় থেকে-নাও থামাও মাঝি, নইলে গুল্লি চালাইয়া সব ঝাঁঝরা কইরা ফালামু।
ফখরুদ্দীন খান আস্তে করে বলেন মাঝিকে-নাও থামাও জব্বার। ভয় নেই, আমি দেখছি।
আপনার দেখতে হইবে না মিয়াভাই। আল্লার কসম আপনের, আপনে চুপ থাইকেন। যা কওনের আমিই কমু।
এবার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে খান সাহেব বললেন, পতাকাটা সামলাও। পতাকা দেখলে কিন্তু ক্ষেপে যাবে ওরা।
নিজের কোমরে বাম হাতটা বোলান রবিনের মা। না, ঠিক আছে। জায়গামতো আছে পতাকাটা।
জব্বার মাঝি আস্তে আস্তে নৌকাটা পাড়ে ভিড়ায়।
খালের পারে ছোট্ট একখণ্ড জমি। সেখানে শাক-সবজির চাষ করেছে গ্রামের কোনো কৃষক পরিবার। তার পরেই ওয়াপদার বেড়িবাঁধ। সেই বেড়িবাঁধকেই গ্রামের লোকজন রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করছে। সেই রাস্তা থেকে জমির আল বেয়ে নৌকার দিকে এগিয়ে আসে দশ-বারোজনের একটি দল। তাদের পায়ের তলায় পিষ্ট হতে থাকে কৃষকের লাগানো শাক-সবজির গাছ।
দলের একেবারে সামনে নেতা গোছের একটি লোক। পরনে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। তাও মারা গোঁফ দুগালে। দাড়ি থাকলেও খুব বড় না, বোঝাই যায় তার দাড়ির বয়স খুব বেশি নয়।
নেতা লোকটির হাতে একটি তিন ব্যাটারির টর্চ লাইট। সম্ভবত এই লোকটিই এস্কান্দার হাওলাদার। পাশে অন্য একজনের হাতে রাইফেল জাতীয় কিছু একটা অস্ত্র। সেটি তাক করে ধরে আছে নৌকাটির দিকে। বাকি সবার কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে জ্বলন্ত বিড়ি বা সস্তা ব্র্যান্ডের সিগারেট।
নৌকার কাছে এসে নেতা লোকটি হুকুম দিলো-এই সার্চ কর।
প্রথমে বাধা দিলো মাঝি। থামেন, ভিতরে উঠবেন না। নাওয়ে ভদ্রমহিলা আছে।
কিন্তু চামচা গোছের একটি লোক সে বাধাকে পাত্তা না দিয়ে মাঝিকে একটা ধাক্কা মেরে উঠে গেল নৌকায়। ধাক্কাটা এতো জোরে মারলো যে জব্বার মাঝির খালে পড়ে যাওয়ার অবস্থা হলো। অনেক কষ্টে ছইয়ের সঙ্গে ঠেক দিয়ে নিজের পতন ঠেকালো সে।
প্রথম লোকটির পেছন পেছন আরও দুটো লোক লাফিয়ে নৌকায় উঠলো। নৌকা থামানোর আগেই ছইয়ের বাইরে এসে বসেছিলেন খান সাহেব। এবার উঠে দাঁড়ালেন।
ছইয়ের সঙ্গে একটা বিছানার চাদর গুঁজে দিয়ে পর্দা বানানো হয়েছিলো। প্রথম লোকটি কিছুটা নুয়ে পড়ে এক ঝটকায় পর্দাটা ফেলে দিলো। তারপর কমান্ডারকে উদ্দেশ করে বললো, নৌকার ভিতরে একজন মাইয়া মানুষ আর একটা বাচ্চা মাইয়া ছাড়া কেউ নাই।
পাটাতনের নিচে দেখ্। ওপর থেকে নির্দেশ এলো।
লোক তিনটি পাটাতনের কাঠগুলো সরিয়ে সরিয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলো। কিছুই না পেয়ে আবার বললো, কিচ্ছু নাই ওস্তাদ।
ঠিক আছে উঠে আয়।
একে একে তিনটি লোকই নৌকা থেকে নেমে গেলো। এরপরে নৌকায় উঠলো টর্চ হাতে নেতা গোছের লোকটি। উঠে হাত মিলালো ফখরুদ্দীন খানের সঙ্গে। কিছু মনে করবেন না আপনাদেরকে কষ্ট দিলাম বলে। আসলে এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারটা তো আমাগোই দেখতে হয়। শালা মুক্তির বাচ্চারা দুদিন পরপরই ঠুসঠাস ফুটফাট কর। শালারা বাঁশের লাঠি দিয়া দ্যাশ স্বাধীন করবো! খাড়া, আর কয়টা দিন সবুর কর। তোগো বাপেরা আইয়া পড়ছে। স্বাধীন করাইবে তোগো দ্যাশ।
ফখরুদ্দীন খানও মনে মনে বললেন, তোগো বাপেরাও আইতে আছে হালার পো হালারা। আর কয়দিন সবুর কর। পাকিস্তানিগো দালালি করার সাধ তোগো জন্মের তরে মিডাইবেয়ানে।
এমনিতে ফখরুদ্দীন খান শুদ্ধ ভাষায় কথা বললেও মনে মনে গালিটা তিনি কেন যেনো আঞ্চলিক ভাষায়ই দিলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন