সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১২

কুয়াশা ঢাকা দিন : পর্ব-৯

পর্ব-
নৌকাঘাটের পাশের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে জব্বার মাঝির দিকে চোখ পড়লো রবিনের বাবার। একই সঙ্গে জব্বার মাঝিরও চোখ পড়লো ফখরুদ্দীন খান সাহেবের দিকে। চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠলো মাঝি-মিয়াভাই কেমন আছেন? অনেকদিন আপনের বাসায় যাই না। ভাবীছাব কেমন আছেন?
ভালো। বলেই ইশারায় মাঝিকে কাছে ডাকলেন খান সাহেব।
মাঝি তার ছোট্ট চুলায় আমকাঠের লাকড়ি দিয়ে জ্বাল দিচ্ছিলো। মাটির হাঁড়িতে ভাত রান্না করছিলো সে। ইশারা পেয়েই তাড়াতাড়ি নৌকা থেকে লাফিয়ে নেমে খান সাহেবের কাছে এলো।
মাঝিকে ডেকে একটা নিরালা জায়গা খুঁজতে লাগলেন ফখরুদ্দীন খান। পেয়েও গেলেন। খালের পাশেই ছোট্ট একটা দোকান। দুপুরের গরমে সেখানে বসে ধুঁকছে বাচ্চা একটি ছেলে। রাস্তায় লোকজন তেমন একটা নেই। মাঝিকে নিয়ে দোকানের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চটিতে বসলেন খান সাহেব। বসেই নিজে একটা সিগারেট ধরালেন, মাঝিকেও দিলেন একটা। তারপর আস্তে করে বললেন, জব্বার রে, এখানে তো আর থাকতে পারছি না। বদমাশগুলো খুব বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করেছে।
মিয়াভাই, কইছিলাম কী, গেরামের বাড়ি চলেন, আমাগো গেরামটা এহনও নিরাপদ আছে।
জব্বার মাঝি খান সাহেবদের গ্রামেরই লোক।
সেজন্যই তোকে ডাকলাম।
চলেন তাইলে। কবে যাইবেন? কহন?
আজই।
কিন্তু মিয়াভাই, যাইতে হইবে রাইতে। নইলে ওই হালার পো হালারা সন্দেহ করবে।
হ্যাঁ রাত্রেই যাবো।
তাইলে একটা কাম করেন, আপনেরা সবকিছু ঠিকঠাক কইরা রাইখেন, আমি ঠিক মাঝরাত্তিরে আপনেগো ঘাটে থাকমু।
আমাদের ঘাটটা খুব একটা নিরাপদ না। থানার স্পিডবোটগুলো দিন রাত সব সময় ওই পথেই চলে।
রাইতে বেশি একটা চলে না। অগো মনেও তো এহন কম ডর না। জাগায় জাগায় গুড়াগাড়া পোলাপানের ধারে মাইর খাইতেছে।
তুই দেখি এইসব খবরও রাখিস।
রাখমু না মিয়াভাই! জানেন আমার নাওতে একখান রেডিও আছে।
বলিস কী? কেউ জানতে পারলে কী হবে জানিস?
জানি। তয় চিন্তা নাই। রাখছি এমন জায়গায় অগো চৌদ্দ গুষ্টিরও সাধ্য নাই বিচড়াইয়া বাইর করবে।
কই রেখেছিস?
রাখছি নাওয়ের গুড়ার মইধ্যে, যেই জায়গায় বইয়া নৌকা বাই হেই জায়গায় একটা খোড়ল বানাইয়া হেইর মইধ্যে রাখছি। বাইরে দিয়া বোজনোর কোনো উপায় নাই।
যখন শুনতে বের করিস তখন যদি কেউ দেখে ফেলে?
দেখবে না। বনজঙ্গলের মধ্যে নিরিবিলি জায়গা পাইলেই খালি বাইর করি টানজিস্টরডা। বাইর কইরা ওই যে মুকুল না কেডা যেনো একটা চরমপতরো না কী পড়ে হেইডা হোনতে খুব মজা লাগে। আর শেখ সাইবের ভাষণ যহন শুনি, বিশ্বাস করেন মিয়াভাই, গায়ে কাডা দিয়া ওডে। মনে হয় বৈঠা লইয়া এহনই ঝাপাইয়া পড়ি। বৈঠা দিয়া ওই হালার পো হালাগো একটা একটা কইরা পিডাইয়া মারি।
জব্বার মাঝির মধ্যে চাপা একটা উত্তেজনা টের পান খান সাহেব।
কেউ তাদের কথা শুনে ফেলছে নাকি খেয়াল করার জন্য এদিক ওদিক তাকান ফখরুদ্দীন খান।
না কেউ নেই। দোকানের ছোট্ট ছেলেটা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে তাঁদের দিকে। কিন্তু তাঁদের কথা শুনছে কি না বা শুনলেও কিছু বুঝতে পারছে কি না বোঝা যাচ্ছে না তার চোখ দেখে। দূরে কবরস্থানের পাশে ঘাস খাচ্ছে কয়েকটি গরু।
জব্বার মাঝি আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসে। চিন্তা কইরেন না মিয়াভাই। দেইখেন আমাগো পোলাপানে ঠিকই একদিন অগো এই দেশ দিয়া খেদাইবে।
তা ঠিক, তবুও মুহূর্তে আমাদের সাবধান থাকা ভালো। সাবধানের তো কোনো মার নেই।
আপনেরা আগে হইতেই রেডি হইয়া থাকলে সময় বেশি লাগবে না মিয়াভাই। আপনেগো নায়তে উডাইয়াই ছোট খালের ভিতের ঢুইক্যা যামু আমরা। তাইলে আর কোনো বিপদ নাই।
হ্যাঁ। আর যেতে হবে কিন্তু পুবদিকের ওই ছোট্ট খাল দিয়েই। থানার ওদিকে যাওয়া যাবে না।
হেইসব লইয়া আপনের চিন্তা করা লাগবে না। তয় মিয়াভাই দেশের অবস্থা কী হইবে মনে হয় আপনের?
ফখরুদ্দীন খান চোখ ঘুরিয়ে চারদিকটা আরেকবার দেখে নিলেন। না, রাস্তায় কোনো লোকজন নেই। থানার দিক থেকে আসা জোয়ারের পানিতে ঘাটে ভেড়ানো নৌকাগুলো পাড়ের সঙ্গে আড়াআড়ি হয়ে ভিড়ে আছে। খালের ওপার থেকে একটা কুকুর সাঁতরে খাল পাড় হচ্ছে। বারবার দিক পরিবর্তন করেও গন্তব্যের দিকে ঠিকমতো এগুতে পারছে না কুকুরটা। স্রোত তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে।
মাঝির সঙ্গে বলা প্রসঙ্গ ভুলে গিয়ে কুকুরটার অবস্থা দেখতে লাগলেন খান সাহেব। দোকানঘরটা বরাবর সাঁতার দিচ্ছিলো কুকুরটি। কিন্তু খালের মাঝামাঝি আসতে আসতেই স্রোতের ধাক্কায় সে বেশ খানিকটা ডানদিকে চলে গিয়েছিলো। টের পেয়ে বাঁ দিকে ঘুরে স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতরালো কিছুক্ষণ, তারপর আবার পাড়ের দিকে সাঁতরাতে শুরু করলো। এবার সে ঠিকই সাঁতরে দোকানটার কাছাকাছি পাড়ে এসে উঠলো। উঠেই ঝাড়া দিয়ে গায়ের পানি ঝরালো। কুকুরটার চোখে মুখে একটা পরিতৃপ্তির ছাপ আন্দাজ করে নিলেন ফখরুদ্দীন খান। এবার চোখ ফেরালেন মাঝির দিকে।
খান সাহেব অন্যমনস্ক থাকায় জোরে জোরে বেশ কয়েক টান দিয়ে সিগারেটটি প্রায় শেষ করে ফেললো মাঝি। মিয়াভাইর দেয়া সিগারেট খেলেও সরাসরি তার সামনাসামনি সিগারেটে টান দেয় না মাঝি। তাই খান সাহেবের অন্যমনস্কতার সুযোগটা নিলো সে। খান সাহেব ফিরে তাকাতেই হাতের সিগারেটটা ছুড়ে মারলো মাঝি। তারপর খান সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো তার প্রশ্নের উত্তরের আশায়। কিন্তু খান সাহেব কোনো উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন মাঝিকেই, তোর কী মনে হয়?
মাইনি?
মানে হলো, তুই যে প্রশ্নটা করেছিস তার উত্তরটা তোর কাছেই জিজ্ঞেস করছি।
আমার মনে হয় কী মিয়াভাই, এইবার বাঙালিরে আর দমাইয়া রাখতে পারবে না। আমাগো এতো এতো পোলাপান যে মরণরে না ডরাইয়া যুদ্ধ করতেছে এইসব তো বৃথা যাইতে পারে না। দেইখেন, জয় আমাগো হইবেই।
আমারও তাই মনে হয়। বলতে বলতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন খান সাহেব। জব্বার মাঝিও দাঁড়ালো তার সঙ্গে সঙ্গে। মাঝিকে নৌকায় যেতে ইশারা করে বাসার দিকে হাঁটতে লাগলেন ফখরুদ্দীন খান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন