পর্ব-১৭
জায়গাটাকে সুন্দরবন বলা হলেও
এটি আসলে মূল
সুন্দরবন না। বলেশ্বর নদীর মাঝখানে হয়তোবা অনেক অনেক
বছর আগে জেগে
উঠেছিলো বিশাল এক
চর। দিনে দিনে
সেখানেও একটা বন
গড়ে উঠেছে। সুন্দরবনের সঙ্গে তফাত
তেমন একটা নেই
এই চরটির। সুন্দরবনে যা কিছু
আছে তার প্রায়
সবই আছে এই
বনে। সুন্দরী গরান গেওয়াগাছ গোলপাতা হরিণ বানর
সবই আছে, নেই
শুধু সুন্দরবনের বাঘ। আর
এজন্যই লোকজনের কাছে এই
স্থানটি খুব প্রিয়। প্রতিবছর শীতকালে অনেক লোক
এখানে পিকনিক করার জন্য
যায়। অনেকে যায়
শুধুই বেড়াতে।
রবিনও
গেছে দুয়েকবার।
একবার
স্কুলের এক পিকনিকে এসে খুব মজা
করেছিলো ওরা। তখনও
শিশির ছিলো। বিশাল
এক নৌকা ভাড়া
করা হয়েছিলো। স্কুলের পণ্ডিত স্যার প্রায়
সারা পথ গান
গেয়ে মাতিয়ে রাখেন সবাইকে।
পণ্ডিত স্যারের কথা মনে
হওয়ায় মনটা খারাপ
হয়ে যায় রবিনের। পণ্ডিত স্যার যে
শুধু ভালো পড়াতেন তা-ই নয়,
চমত্কার গানও গাইতেন তিনি। রবীন্দ্রসঙ্গীত যে এতো
ভালো লাগতে পারে
তা স্যারের গান শোনার
আগে বুঝতে পারেনি রবিন।
রবিনদের বাসার সামনে একটা
পুকুর। সেই পুকুরের ওপারেই থাকতেন পণ্ডিত স্যার। সবাই পণ্ডিত স্যার ডাকলেও স্যারের চেহারায় মোটেও পণ্ডিত পণ্ডিত ভাব ছিলো
না। অল্প বয়স।
বিয়েও করেননি তখনও। নির্জন সকালে নিজের বাসায়
বসে গান গাইতেন স্যার-
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না ॥
এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে উদ্ভ্রান্ত মেঘে মন চায়
মন চায় ওই বলাকার পথখানি নিতে চিনে॥
মেঘমল্লার সারা দিনমান।
বাজে ঝরনার গান।
মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা--মন চায়
মন চায় হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে॥
জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না ॥
এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে উদ্ভ্রান্ত মেঘে মন চায়
মন চায় ওই বলাকার পথখানি নিতে চিনে॥
মেঘমল্লার সারা দিনমান।
বাজে ঝরনার গান।
মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা--মন চায়
মন চায় হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে॥
পুকুরের এপারের ঘাটলায় বসে একমনে
সে গান শুনতো
রবিন। একজন ছাত্র
কীভাবে এতো ভালো
একজন স্যারকে মারতে পারে
ভাবতেই পারে না
রবিন।
রবিনদের বাসার পাশ দিয়ে
যে খালটি গেছে
পশ্চিম দিকে, সে
খাল সোজা গিয়ে
মিশেছে বলেশ্বরের সঙ্গে। খালের মাথায়
গিয়ে দশ মিনিটের মতো সময় নৌকা
বাইলেই ওই চরে
পৌঁছে যাওয়া যায়।
খালের মোহনায় পানিও সামান্য। পুরো মোহনাটাই ডুবো চরে
ভরা। তাই ঢেউও
নেই বললেই চলে।
দিনের বেলা জেলেরা পানির মধ্যে অনেকটা হেঁটে হেঁটেই খুঁচনি জাল দিয়ে
মাছ ধরে এই
নদীতে। বাকিটা তো খালই।
এইটুকু পথ রবিন আর
শিশিরের জন্য নৌকা
বেয়ে যাওয়া খুব
একটা কঠিন নয়।
এই চিন্তা করেই নৌকা
নিয়ে রওনা দিয়েছিলো ওরা। কিন্তু কিছুদূর যেতে না
যেতেই ওরা বুঝলো
কাজটা এতো সহজ
নয়। স্রোতের টানে নৌকা
নিয়ে কোনোভাবেই এগুতে পারছিলো না ওরা। তাছাড়া অনেক জায়গায় খালপাড়ে এতো ঘন
গাছপালা যে অন্ধকারে এক ভুতুড়ে পরিবেশের মধ্যে পড়তে
হলো ওদেরকে। এভাবে কিছুদূর এগিয়ে একটা বড়ো
ধানক্ষেতের কাছে নৌকা
থামালো ওরা। এই
জায়গায় বড় কোনো
গাছপালা না থাকায়
চাঁদের আলোয় দিনের
মতো পরিষ্কার দেখাচ্ছিলো সবকিছু। ভাটা না
হওয়া পর্যন্ত এই জায়গায় নৌকা থামিয়ে রাখবে বলে
ঠিক করলো রবিন
আর শিশির। ভাটার সময়
খালের পানি নদীর
দিকে যেতে থাকবে। তখন স্রোতই টেনে নিয়ে
যাবে নৌকা।
নৌকা
থামিয়ে পাটাতনের ওপর চিত্
হয়ে শুয়ে পড়লো
দুজন। মাঝ আকাশে
ভরা চাঁদ তখন
নরম একটা আলো
ছড়াচ্ছে। খালের পাড়ে
কী একটা ঝাকড়া
গাছের মাথায় জোনাকিরা জ্বলছে আর নিভছে। মনে হচ্ছে একসঙ্গে সবগুলো জোনাকি পোকা জ্বলে
উঠছে আবার একসঙ্গে সবগুলো নিভে যাচ্ছে। দেখে বড়ো অদ্ভুত মনে হয় রবিনের কাছে।
স্রোতের পানি নৌকার সঙ্গে
ধাক্কা খেয়ে কুলু
কুলু শব্দে বয়ে
চলেছে। দূরে ঘন
ঘন ডেকে চলেছে
একটা রাতপাখি।
ওদের
মধ্যে প্রথম কথা
বললো রবিন। ভয়
করছে শিশির?
নারে।
তাহলে
কথা বলছিস না
যে।
চিন্তা করছিলাম।
মাসিমার কথা মনে পড়েছে
বুঝি?
না,
বাবার কথা চিন্তা করছিলাম।
তোকে
খুব ভালোবাসতেন মেসোমশাই।
তোকেও
ভালোবাসতেন।
কী
করে বুঝলি?
পুজোর
সময় আগে নিজে
পছন্দ করে তোর
জন্য জামা-কাপড়
কিনতেন। তারপর আমাকে
কিনে দিতেন।
আচ্ছা
শিশির, মনে আছে,
ছোটবেলা থেকেই তোর
প্রচণ্ড ভয়। অন্ধকারের দিকে তাকাতেও ভয় করতি
তুই। রাতে পড়ার
টেবিলে বসে দরজা
দিয়ে বাইরের দিকে তাকাতে পারতি না। কোনো
দিন সন্ধ্যার পরে বাইরে
থাকার কথা তো
চিন্তাই করা যেতো
না।
হ্যাঁ,
কিন্তু একদিন একটা
বিপদে পড়েছিলাম।
কী
রকম?
বিকালে মা বলেছিলেন কেরোসিন আনতে। গলায়
রশি প্যাঁচানো কেরোসিনের বোতল নিয়ে
গিয়েছিলাম খেলার মাঠে।
ভেবেছিলাম কিছুক্ষণ খেলেটেলে তারপর বাজার
থেকে কেরোসিন নিয়ে বাসায়
ফিরবো। কিন্তু খেলতে খেলতে
কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে
টের পাইনি। টের পেতেই
দৌড়ে বাজারে গেলাম। কিন্তু কেরোসিন নিয়ে ফিরতে
ফিরতে পথঘাট সব
অন্ধকার হয়ে গেল।
এ
পর্যন্ত বলে রবিনের দিকে পাশ ফিরে
শুলো শিশির। রবিন জিজ্ঞেস করলো-তারপর? অন্ধকারে তুই বাসায়
ফিরলি কী করে?
বাজারের এই প্রান্তের দোকানটা পর্যন্ত এসেই থেমে
গেলাম আমি। ওই
দোকানটা থেকে বাসায়
হেঁটে আসতে পাঁচ
মিনিটের মতো সময়
লাগে। কিন্তু এই পথটুকুর দিকে পা দিতে
কিছুতেই সাহস হলো
না। এভাবে অনেকটা সময় চলে গেলো।
কী
করলি তখন?
একবার
অনেক সাহস করে
হাঁটতে শুরু করলাম। ভগবানকে ডাকতে ডাকতে
অর্ধেকটা পথ এসে
গেলাম। এমন সময়
ঘটলো কাণ্ডটা।
কী
কাণ্ড? আগ্রহ নিয়ে
জানতে চাইলো রবিন।
ধবধবে
সাদা একটা ভূত
দেখতে পেলাম সামনে।
ভূত!
সত্যিকারের ভূত?
আরে
না, বলছি।
একটু
থেমে আবার বলতে
লাগলো শিশির। সাদা লম্বা
ভূতটা দেখার পরে
কী করবো বুঝতে
পারছিলাম না। ভূত
দেখে নাকি পেছনে
দৌড়াতে নেই। ওদিকে
সামনে পা চলছে
না। শোঁ শোঁ
শব্দে বাতাস এসে
লাগছিলো গায়ে। চিত্কার করতে চাইলেও মুখ থেকে
কোনো আওয়াজ বেরুচ্ছিলো না। শেষে পেছন
ফিরে জোরে এক
দৌড় লাগালাম। এক দৌড়ে
বাজারের একেবারে মাঝখানে। রবিনকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না
দিয়ে একনাগাড়ে বলে যেতে
লাগলো শিশির।
দৌড়ে
এসে জান তো
বাঁচালাম, কিন্তু বাসায় ফিরবো
কী করে? ওদিকে
ভয়ে হাত পা
তখনও কাঁপছিলো। এ অবস্থায় আবার ওইমুখো হওয়ার কথা
ভাবতেই পারছিলাম না। অনেকক্ষণ রাস্তায় ঘোরাঘুরি করলাম আমাদের আশপাশের বাসার কাউকে
পাওয়া যায় কি
না। কিন্তু না, একজন
লোকও পেলাম না।
ওদিকে দোকানদাররা অনেকেই দোকান বন্ধ
করে দিচ্ছিলো। ছোট দোকানদাররা তাদের হারিকেন বা কুপিবাতি বন্ধ করে টর্চলাইট হাতে যার যার
বাড়ির পথে ফিরছিলো। দুয়েকটা বড় দোকানে তখনও হ্যাজাক বাতি জ্বলছিলো। সারা দিনের হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে তারাও একে একে
বাড়ির পথ ধরলো
সবাই। পুরো বাজারটাই তখন প্রায় অন্ধকার। তার মধ্যেই দূরে একটা
হ্যাজাকের আলো দেখে
সেদিকে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে অবশ্য কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। হ্যাজাক জ্বালিয়ে লাল শালু
কাপড়ে সাদা বড়ো
বড়ো অক্ষরে ব্যানার লিখছিলেন সাইনবোর্ড আর্টিস্ট পান্না। আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আ. জব্বার মিয়াকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে বোতল মার্কায় ভোট দিন। মাঝেই
বড় একটা বোতলের ছবি।
মনে
মনে ভাবলাম, যাক, বাসায়
যদি ফিরতে না-ই পারি
তাহলে সকাল পর্যন্ত এখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দেবো।
তাহলে
সারারাত সেখানেই কাটালি? জিজ্ঞেস করলো শিশির।
না।
রাত যখন বারোটা-একটা, তখন লেখা
বন্ধ করে তুলিটুলি ধুয়ে গোছাতে শুরু করলো
আর্টিস্ট। দেখে তো
ভয়টা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো আমার।
শেষে
তুই কী করলি
বল না! তাড়া
দিতে লাগলো রবিন।
শেষে
বাবাই বিপদের হাত থেকে
বাঁচালেন।
ও,
তিনি বুঝি খুঁজতে বেরিয়েছিলেন তোকে?
না।
তিনি ফিরছিলেন অফিস থেকে।
অতো
রাতে অফিস থেকে
ফিরলেন?
সে
আরেক কাহিনী। অন্য একদিন
বলবো। বাবার কথা
আজ আর মনে
করতে ভালো লাগছে
না। তবে সংক্ষেপে এইটুকু বলি, রোগী
দেখতে কোনো গ্রামে গিয়েছিলেন। তাই ফিরতে
তার অতো রাত।
রবিন
বললো, এতো ভালো
একটা লোককে মেরে
ফেলতে পারলো ওই
আলী রাজাকারের দল!
শিশির
মুখে কোনো কথা
বললো না। তার
বুক ফেটে বেরিয়ে এলো দীর্ঘ এক
নিঃশ্বাস। সে মনে
মনে শুধু ভাবলো,
এই দেশটা স্বাধীন করতে পারলে আলী
মিয়ার জিহ্বাটা সে টেনে
ছিঁড়ে ফেলবে। তারপর লাথি
দিয়ে লাশটাকে গাঙের পানিতে ভাসিয়ে দেবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন