সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ, ২০১২

টাট্টুঘোড়া


আজ বেশ সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো টুকুনের। পুব আকাশ যখন ফর্সা হয়ে আসছে, একটু পরেই সেখানে উঁকি দেবে ইয়াবড়ো লাল সূর্য, গেরস্তবাড়ির মোরগগুলো যখন কুক-কুরু-কুক-কুক বলে বাগ ছাড়ছে, গাছে গাছে পাখিরা যখন ভোরের আলো দেখে কিচির-মিচির শুরু করেছে, গরুগুলো গোয়ালঘর থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য হাম্বা হাম্বা করছে, ঠিক তখনই ঘুম ভাঙলো টুকুনের।
ঘুম তো ভাঙবেই। আজ যে পহেলা বৈশাখ!
টুকুনদের বাড়ির খুব কাছেই রয়েছে একটা বাজার। সেই বাজারে আজ মেলা বসবে। বৈশাখী মেলা। সেখানে কতো কিছু যে পাওয়া যাবে আজ! কুমোরপাড়ার লোকজন নিয়ে আসবে মাটির তৈরি হাতি ঘোড়া বাঘ হরিণ রঙিন পাখি মেয়ে পুতুলসহ নানান রকমের খেলনা। মুড়ি মুড়কি নাড়ু নিয়ে বসবে দোকানিরা। নাগরদোলা আসবে। বসবে পুতুল নাচের আসর। সারাদিন সেগুলো ঘুরে ঘুরে দেখবে টুকুন।
ঘুরে ঘুরে শুধু দেখবে। এতোকিছু কেনার মতো পয়সা তার নেই। তাই এই একটা দিন তার প্রিয় খেলনাগুলো দেখে দেখেই সুখ পায় টুকুন। তবে হ্যাঁ, কিনবে। একটা জিনিস সে কিনবে বলে গত বছরের মেলার সময়ই ঠিক করে রেখেছিলো। মাটির একটা টাট্টুঘোড়া কিনবে এবার টুকুন। গত মেলায় রকম আরেকটা ঘোড়া দেখে তার খুব পছন্দ হয়েছিলো। কিন্তু পয়সা ছিলো না বলে কিনতে পারেনি। তাই এই এক বছর ধরে পয়সা জমিয়েছে। আজ সেই পয়সায় একটা মাটির টাট্টুঘোড়া সে কিনবে।
এসব চিন্তা করতে করতে তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়ে টুকুন। উঠে হাত মুখ ধোয়। মা আগেই থালায় পান্তাভাত রেখে দিয়েছেন। সেই পান্তাভাত খেয়ে মেলার দিকে রওনা দেয়।
সকাল সকাল মেলায় লোকজন তেমন আসে না। তবে দোকানিরা আসে। এসেই তারা যার যার দোকান সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আজও টুকুন যখন মেলায় গেলো তখন দোকানিরা ব্যস্ত তাদের দোকান সাজাতে। মেলার মাঠের এককোণে পুতুল নাচের লোকজন প্যান্ডেল বানাচ্ছে। কয়েকটি জায়গায় নাগরদোলা বসাবার জন্য খুঁটি পুঁতছে কেউ কেউ। আর এককোণে বসেছে মাটির যতো খেলনাপাতির দোকান। টুকুন সেদিকটার দিকে এগিয়ে যায় আগে। সেখানে কুমোরপাড়ার লোকজন বড় টুকরিতে করে নিয়ে এসেছে কতো রকমের খেলনা! হাতি ঘোড়া বাঘ হরিণ খরগোস তো আছেই, আরও আছে হাঁস মুরগি টিয়া ময়না; আছে মাটির আম কাঁঠাল বেল তরমুজ এইসব। আর টুকুনের সেই প্রিয় টাট্টুঘোড়া? তাও আছে। অনেকগুলো টাট্টুঘোড়া এবার মেলায় এনেছে কুমোররা। টুকুন সেগুলোর দিকে এক এক করে চোখ বুলাতে থাকে আর মনে মনে ভাবতে থাকে কোনটা কিনবে সে।
কিনবে। তবে এখনই কিছু কিনবে না। সারাদিন ঘুরে ঘুরে মেলা দেখে শেষ বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় কিনবে টাট্টুঘোড়াটা। নইলে এত বড় মাটির ঘোড়া নিয়ে সারাদিন ঘুরতে পারবে না সে। তবে একটা ঘোড়া পছন্দ করে দোকানিকে বলে রাখবে সেটা বিক্রি না করতে। ফেরার পথে পয়সা দিয়ে সেটা নিয়ে নেবে টুকুন।
দেখতে দেখতে মেলায় লোকজনের ভিড় বাড়তে লাগলো। বাড়তে বাড়তে এমন হলো যে একসময় মানুষের ভিড়ে হাঁটাচলাও করা যাচ্ছিলো না। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছিলো। টুকুন ভাবলো এবার সে বাড়ি ফিরবে। ফেরার পথে শেষবারের মতো কুমোরদের দোকানে গেলো সে। গিয়ে তার পছন্দের ঘোড়াটার দিকে আরেকবার তাকালো। না, আগে থেকে দোকানিকে বলে রাখায় কাজ হয়েছে। তার পছন্দের ঘোড়াটা বিক্রি করেনি এখনও।
ভাবতে ভাবতে নিজের পকেটে হাত দিলো টুকুন। কিন্তু কী! একটি পয়সাও নেই। এক এক করে সবগুলো পকেট বারবার হাতড়ালো সে। কোনো পয়সাই নেই। তাহলে এবারও তার ঘোড়া কেনা হবে না!
টুকুনের মুখটা কালো হয়ে গেলো। চোখে প্রায় পানি এসে গেলো তার। সেই পানি কোনোভাবে সামলে নিয়ে দোকানের সামনে থেকে তাড়াতাড়ি সরে পড়লো সে। মুখ অন্ধকার করে বাড়ি ফিরে এলো টুকুন। এসেই শুয়ে পড়লো বিছানায়। সারাদিন মেলায় হাঁটাহাঁটি করার ক্লান্তিতে তার চোখ দুটো বুজে এলো। এমন সময় দরজায় ঠক্ ঠক্ ঠক্।
কে?
দরজার ওপার থেকে কে যেন চিঁহি চিঁহি করে বললো, টুকুন ভাইয়া দরজা খোলো। আমি তোমার বন্ধু।
বন্ধু! তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুরে দিলো টুকুন।
দরজা খুলে টুকুনের চোখ তো ছাড়াবড়া। তার প্রিয় টাট্টুঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে সামনে। টাট্টু বললো, বাইরে এসো বন্ধু।
টুকুন বাইরে বেরিয়ে এলো। টুকুনকে নিয়ে টাট্টু গেলো তাদের বাড়ির পাশের একটা জায়গায়। সেখানে একটা আমগাছের নিচে গিয়ে থামলো ওরা। টাট্টু বললো, আমি টাট্টুঘোড়া বলে দৌড়ে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। আমাদের অন্য বন্ধুরা পেছনে পড়ে রয়েছে। তবে ওরাও চলে আসবে। ততোক্ষণ তুমি আর আমি এখানে গল্প করি।
টুকুন বললো, তাহলে তুমি ওখানটায় বোসো। সারাদিন ঘুরে ঘুরে তুমি নিশ্চয় ক্লান্ত হয়ে গেছো।
টুকুন বললো, তোমাকেও দেখেছি সকাল থেকে কুমোরদের দোকানে দাঁড়িয়েই রয়েছো। তোমারও নিশ্চয় পা ব্যথা হয়েছে।
আরে না, তা হয়নি। ঘোড়াদের কখনও পা ব্যথা হয় না। কেনো তুমি জানো না, আমরা তো ঘুমাইও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। বললো টাট্টু।
তাই নাকি! জানতাম না তো! টুকুন বললো।
এমন সময় কাছাকাছি কোথাও থপ থপ শব্দ হতে লাগলো। শব্দ শুনে টুকুন কেমন হকচকিয়ে উঠলো।
টাট্টু বললো, গাবদাটা হয়তো এসে পড়েছে।
কথায় টুকুন একটু আশ্চর্য হলো। গাবদা মানে!
টুকুনের কথা শেষ হওয়ার আগেই আরও জোরে জোরে থপ থপ করতে করতে বিশাল দেহের হাতিটা এসে হাজির হলো। এসেই অভিযোগ করলো, কী ভাই টাট্টু, তুমি টগবগিয়ে ছুটতে পারো বলে আগে আগেই চলে এলে! আমাদের জন্য একটু দেরি করলেও তো পারতে।
টাট্টু বললো, আমি তাড়াতাড়ি এসেছি টুকুন ভাইয়ার জন্য। দেখতে পাচ্ছো না, আমাদেরকে না পেয়ে তার কেমন মন খারাপ হয়ে ছিলো। আমি তাড়াতাড়ি আসায় তার মনও তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে গেলো।
এমন সময় ঘোঁত্ ঘোঁত্ শব্দ করতে করতে বাঘ এসে হাজির।
বাঘ আসায় হাতি কেমন একটু নাক কুঁচকালো। টুকুন বললো, কী হলো হাতি বন্ধু, তুমি অমন করে নাক কুঁচকালে কেন?
আর বোলো না, দেখছো না, ওই যে এসে গেছে মেছোটা। সারাদিন মাছ আর বনের জীবজন্তু খেয়ে খেয়ে কী রকম গন্ধ ছড়াচ্ছে দেখছো না!
বাঘও দমবার পাত্র না। সে ঘোঁত্ ঘোঁত্ করতে করতেই বললো, আর তুমিও কম না বাপু। খাও তো সারাদিন কলাগাছ। মনে হয় তোমার মুখ দিয়ে খুব খুশবু ছড়াচ্ছে!
ওদের দুজনের ঝগড়ার মাঝেই শেয়াল এসে হাজির। সে এসে কেমন একটা পণ্ডিত পণ্ডিত ভাব নিয়ে বসলো এককোণে। কিন্তু কিছু বললো না। তাকে দেখে মনে হলো সে গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছে।
এমন সময় আরও এলো হরিণ, বানর, খরগোস, বেড়াল আর রঙিন পাখি। বাঘকে দেখে হরিণ একটু কেমন কেমন করতে লাগলো।
ব্যাপারটা আর কেউ না বুঝলেও শেয়াল ঠিকই বুঝলো। শেয়াল তো বুঝবেই, শুধু শুধুই তো আর তাকে পণ্ডিত বলা হয় না! সে বললো, কী হে হরিণ ভাইয়া, তুমি অমন করছো কেন? আরে তো মাটির একটা বাঘ। তুমি যেমন মাটির হরিণ। ওকে ভয় পাওয়ার কী আছে!
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হরিণের ভয় ভয় ভাবটা কেটে গেলো।
শেয়াল বললো, একটু আগে বাঘ আর হাতি যে ঝগড়াটা করছিলো সেটাও একই ব্যাপার। আমরা এখানে যারা এসেছি তাদের মধ্যে টুকুন ভাইয়া ছাড়া সবাই- তো মাটির তৈরি। আমাদের গা থেকে মাছের গন্ধই বা আসবে কোথা থেকে আর কলাগাছের গন্ধই বা আসবে কোথা থেকে!
শেয়ালের কথা শুনে সবাই নিজের নিজের ভুল বুঝতে পারলো।
শেয়াল আবার বললো, তোমরা সবাই তো জানোই, আজ আমরা এখানে এসেছি টুকুন ভাইয়ার মন ভালো করার জন্য। তাই এখন থেকে আমরা আর কোনো ঝগড়া না করে সবাই মিলে খেলবো।
শেয়ালের কথায় সবাই একসঙ্গে বলে উঠলো, হ্যাঁ, এখন থেকে আমরা সবাই মিলেমিশে খেলবো।
ওদের কথা শুনে টুকুনের মনটা সত্যি সত্যি ভালো হয়ে গেলো।
কিন্তু এমন সময় টুকুন ছাড়া সবাই কেমন হুড়মুড় করে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলো। মুহূর্তের মধ্যে দৌড়ে সবাই টুকুনের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেলো। শেষ সময় টাট্টু শুধু একবার পেছন ফিরে বললো, টুকুন ভাইয়া, মা আসছেন। আমরা পালাই। পরে আবার দেখা হবে।
টুকুনও হাসি হাসি মুখ করে বললো, হ্যাঁ আবার দেখা হবে। সে পর্যন্ত ভালো থেকো সবাই।
এমন সময় টুকুনের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মা বললেন, এই টুকুন ওঠ। সারাদিন মেলায় ঘুরে এসে সন্ধ্যার সময়ই ঘুমিয়ে পড়েছিস। রাতের খাবার খেতে হবে না! হাতমুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি খেতে আয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন