পর্ব-২১
চল্লিশ বছর পর।
রিমি
গেলো তার দাদাবাড়ি বেড়াতে।
বিকালে চা-নাশতা খাওয়ার পর রিমির চাচাতো ভাইবোনেরা বললো, চলো
রিমি আপু, আমাদের পাশের বাড়িতে অনেক সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ
আছে। তুমি তো
ফুল খুব ভালোবাসো। সেখান থেকে তোমাকে অনেক অনেক ফুল
এনে দেবো।
শুনে
রিমি তো ভীষণ
খুশি। ঢাকা শহরের
শাহবাগ থেকে আব্বু
মাঝে মাঝেই ফুল
কিনে দেয় রিমিকে, কিন্তু সেগুলো কেমন যেন
মরা মরা। মনে
হয় তাতে কোনো
প্রাণ নেই। সেখানে ফুলগাছ থেকে ফুল
তোলা তো দূরের
কথা, ফুলগাছ দেখার ভাগ্যও হয় না কারও
কারও।
রিমির
দাদা রবিন খানের
বাড়ির পেছনের বাগানের সামনে দিয়ে
একটি ছোট্ট রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে।
কোথায় গেছে তা
রিমি জানে না।
সেই রাস্তা দিয়ে খানিকটা হেঁটে আরও ছোটো
একটি রাস্তা দিয়ে একটি
বাড়িতে ঢুকলো ওরা।
চারদিকে বেড়ার আড়াল
দেয়া ছোট্ট একটা
বাড়ি। বাইরে থেকে
বোঝা যায় না
এর ভেতরে কী
আছে। সুপারি গাছের শুকনো
পাতার বেড়া ফাঁক
করে ওরা ঢুকলো
বাড়ির ভেতর। ঢুকে
তো রিমির চোখ
ছানাবড়া। ছোট্ট জায়গাটার ঠিক মাঝখানে আরও ছোট্ট
একটি টিনের ঘর।
আর তার চারপাশে কতো রকমের কতো
ফুলের গাছ তা
গুনে শেষ করা
যাবে না। মনে
হয় ছোট্ট ঘরটিকে ঘিরে রেখেছে নানা ধরনের
ফুলগাছ। সেইসব গাছের
মাঝখান দিয়ে হাঁটাচলার জন্য সামান্য এক চিলতে
জায়গা। বাকিটা সব ফুলগাছে ভরা। আর সেসব
গাছে এতো এতো
ফুল ফুটে রয়েছে
যে দেখলে মনে
হয় কোনো গাছেই
কোনো পাতা নেই।
মানে ফুলের আড়াল
থেকে পাতারা বের হওয়ার
সুযোগই পাচ্ছে না। গোলাপ
জবা গন্ধরাজ গাঁদা ডালিয়া বেলী ছাড়াও আরও
কতো কতো ফুলের
গাছ যে সেখানে আছে রিমি সেসব
গাছের নামও জানে
না।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব কথা
যখন ভাবছিলো তখনই রিমি
শুনতে পেলো কে
যেনো চেঁচিয়ে বলছে, এই...
কে ওখানে, আমার
ফুলগাছে হাত দিয়েছিস তো আজ তোদের...
বলতে
বলতে ঘর থেকে
বেরিয়ে এলো এক
বুড়ি। লাঠিতে ভর দিয়ে
কুঁজো হয়ে হাঁটলেও চেহারায় তার যেনো
আগুন ঝরে পড়ছে।
দেখে
রিমি থ মেরে
গেলো। তার সঙ্গীসাথীরা বুড়ির গলার আওয়াজ
পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই হাওয়া। রিমি থ
মেরে গেলো আর
কিছুটা ভয় পেয়ে
দাঁড়িয়ে রইলো যেখানে যেমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো ঠিক
সেভাবেই।
দাঁড়িয়ে থাকবে না-ই
বা কেন, রিমি
তো আর বুড়িকে চেনেও না আর
তার কথা জানেও
না। মাত্র গতকালই ঢাকা থেকে আব্বু-আম্মুর সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে রিমি।
লাঠিহাতে বুড়ি বেরিয়ে এসে দেখতে
পেলো রিমি একা
দাঁড়িয়ে আছে। পায়ে
জুতো মোজা, মাথার
চুলগুলো সুন্দর করে সাজানো। এ মেয়েটিকে এ পাড়ার
কোথাও দেখেছে বলে তো
তার মনে হয়
না। সে বুঝলো
এ নিশ্চয়ই এ পাড়ার
কোনো মেয়ে নয়।
নিশ্চয়ই কারও বাড়িতে বেড়াতে এসেছে।
বুড়ি
কিছুটা শান্ত হলো।
রিমির কাছে এসে
সে শান্তভাবে বললো, এই
মেয়ে, কী নাম
তোমার? কোথা থেকে
এসেছো?
রিমি
তার নাম-পরিচয়
বললো।
বুড়ি
বললো, কী জন্য
এখানে এসেছো? কার
সঙ্গে এসেছো?
রিমি
বললো, ফুলগাছ দেখতে এসেছিলাম। আমার চাচাতো ভাইয়েরা আমাকে এখানে
নিয়ে এসেছে।
বুড়ি
বললো, বুঝেছি। এ নিশ্চয় সুমন আর নবীনের কাজ। এ পাড়ার
ছেলেমেয়েগুলো খুবই পাজি
চাইপের। ওরা ভীষণ
জ্বালায় আমাকে। আমি একা
মানুষ। দিনরাত এইসব ফুলগাছ পাহারা দিয়ে রাখতে
হয়। তারপরও সুযোগ পেলেই
কে যে কোথা
থেকে ফুল ছিঁড়ে
নিয়ে পালায়! কেনো
বাবা মিছেমিছি আমাকে এতো
জ্বালাতন করিস তোরা!
এইসব ফুল তো
একদিন তোদের হাতেই
তুলে দেবো আমি।
রিমি
অনেক সাহস করে
বুড়িকে বললো, বুড়িমা, আমাকে কিছু ফুল
দেবে?
এ
কথা শুনেই বুড়ির
মুখ একেবারে অন্যরকম হয়ে গেলো।
মনে হলো কে
যেনো একদলা কালি
এনে তার মুখে
মেখে দিয়েছে, এমন কালো
হয়ে গেলো তার
মুখটা। তারপর বললো
সে, ঠিক আছে,
তোমাকে আজ আমি
একটা ফুল দিচ্ছি। কিন্তু আর যেনো
কোনোদিন ওই দস্যিগুলোর সঙ্গে ফুল চুরি
করতে এসো না।
মনে থাকবে তো?
রিমি
মাথা নেড়ে সায়
জানালো।
এতোশত
ফুলের ভেতর থেকে
একটি ফুল ছিঁড়ে
দিয়ে বুড়ি রিমিকে তাদের দাদাবাড়ি পৌঁছে দিয়ে
এলো।
সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে
চাচাতো ভাইবোনগুলো রিমিকে বললো, জানো
রিমি আপু, বুড়িটা না ভীষণ বদমেজাজী। তবে সব সময়
নয়, যখন তার
ফুলগাছে কেউ হাত
দেয়, তখন। ফুলগাছগুলোকে সে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। সারা বছর সে
ফুলগুলিকে যত্ন করে
রাখে। বুড়ির সামনে
কেউ তার ফুলগাছে হাত দেয়া তো
দূরের কথা, তার
বাড়ির আশপাশেও ভিড়তে পারে
না। বুড়ি যদি
বোঝে যে কেউ
ফুল তুলতে তার
বাড়ির আশপাশে গেছে তাহলেই লাঠি নিয়ে তেড়ে
আসে।
সুমন
বললো, তবে বছরের
একটি দিন অন্যরকম হয়ে যায় সে।
দিনটি হলো ষোলোই
ডিসেম্বর। ষোলোই ডিসেম্বরের তো মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। সেই
দিন দেখো অন্যরকম এক বুড়িকে দেখবে।
দেখতে
দেখতে ষোলোই ডিসেম্বর এসে গেলো।
সেদিন
খুব সকাল সকালই
সুমন আর নবীন
রিমিকে নিয়ে গেলো
বুড়ির বাড়িতে। গিয়ে রিমির
তো চোখ ছানাবড়া। মনে হয় সারা
গ্রামের সব ছেলেমেয়ে বুড়ির বাড়িতে হাজির হয়েছে। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের হইচই আর কলকাকলিতে অন্যরকম এক পরিবেশ হয়েছে সেখানে।
বুড়ি
নিজের হাতে সব
গাছের ফুল যত্ন
করে একটা একটা
করে তুললো। বড় একটা
চাদরের ওপর সেগুলো জড়ো করলো সে।
তারপর মুঠি মুঠি
করে সেগুলো তুলে দিলো
সব ছেলেমেয়ের হাতে। সবাই
ফুল নিয়ে লাইন
ধরে বাড়ির সামনের রাস্তাটি দিয়ে এগিয়ে
চললো কোথায় যেনো।
সবার হাতে সব
ফুল তুলে দিয়ে
বুড়ি একদৃষ্টিতে তাদের চলে
যাওয়ার পথের দিকে
তাকিয়ে রইলো।
সবার
সঙ্গে সঙ্গে রিমিও
ফুল নিয়ে এগিয়ে
চললো।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা
শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে
পৌঁছলো। সবাই সব
ফুল ছিটিয়ে দিলো সেখানে। ওদের দেয়া ফুলে
ফুলে ছেয়ে গেলো
সমস্ত মিনার।
রাতে
দাদুর কাছে বুড়ির
আশ্চর্য সব কাণ্ডকারখানার কথা বললো রিমি।
দাদু
বললো, বুড়ির চালচলনে তোমরা তাকে পাগল
ভাবতে পারো। তাকে
যদি কেউ না
চেনে বা তার
কথা না জানে
তাহলে তা-ই
ভাববে। কিন্তু ফুলবুড়ির জীবনটা আসলে খুবই
দুঃখের। এই দুনিয়ায় তার কেউ নেই।
এই
পর্যন্ত বলে দাদু
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ।
তারপর আবার বলতে
শুরু করলো।
দুদুটো ফুলের মতো ছেলে
ছিলো বুড়ির। দুজনই ছিলো
খুবই বুদ্ধিমান। আর ভালো
ছেলে এবং ভালো
ছাত্র হিসেবেও খুব সুনাম
ছিলো তাদের। এই এলাকার প্রতিটি লোকের বিপদে
আপদে এগিয়ে আসতো
তারা। তার মধ্যে
ছোটোটা, নাম ছিলো
শিশির, সে ছিল
আমার বন্ধু। তারা দুজনই
মাকে খুব ভালোবাসতো।
একদিন
হলো কী, আমাদের দেশে একটা যুদ্ধ
শুরু হলো।
সেটা
ছিল উনিশশো একাত্তর সাল। তখন
বাংলাদেশ আর পাকিস্তান একই দেশ। এক
দেশ হওয়ার পরও
পাকিস্তানিরা আমাদের সবকিছুতেই ঠকাতো। তাতে এ
দেশের লোকজন গেলো
ক্ষেপে। তারা স্বাধীনতা চাইলো। আর তাই
পাকিস্তানিরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের, মানে এদেশের নিরীহ মানুষদের সঙ্গে যুদ্ধ
শুরু করে দিলো।
যুদ্ধের শুরুতেই বড়ো ছেলেটি গেলো যুদ্ধে। আর সেই
অপরাধে ছেলেটির বাবাকে মেরে ফেললো
রাজাকাররা। পরে ছোটোভাই শিশির আর আমি
একসঙ্গেই যুদ্ধে গেলাম।
একদিন
বীরের মতো যুদ্ধ
করতে করতে বড়োভাই সুব্রত শহীদ হলো।
আর শিশির শহীদ
হলো আমার পাশে
দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে
করতেই।
নয়
মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। যারা
যুদ্ধে গিয়েছিলো তারা অনেকেই ফিরে এলো। বুড়িও
অপেক্ষায় রইলো তার
ছেলেরা ফিরে আসবে
বলে। কিন্তু এলো না
তারা। কেউ না
বললেও একসময় সে
বুঝে গেলো তার
ছেলেরা আর ফিরে
আসবে না।
সেই
থেকে বুড়ি সারাবছর ধরে ফুলগাছ লাগায় আর
ফুলগাছের পরিচর্যা করে। আর
ষোলোই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে
সেই ফুল সব
ছেলেমেয়েকে দিয়ে দেয়
শহীদ মিনারে দেয়ার জন্য।
বুড়ি শহীদ মিনারকেই তার ছেলে মনে
করে। সে মনে
করে শহীদ মিনারে ফুল দিলে তার
ছেলেরা সেই ফুল
পাবে আর তাতে
তারা খুব খুশি
হবে।
এসব
কথা শুনতে শুনতে
রিমির চোখ দিয়ে
কখন যে জল
গড়িয়ে পড়তে শুরু
করেছে সে নিজেই
বলতে পারবে না।
রিমি ভাবলো, সে
নিজেও তো আজ
শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে
এসেছে। সেই ফুল
পেয়ে ছেলে দুটো
হয়তো আজও খুব
খুশি হয়েছে।
-শেষ-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন