সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১২

গল্প : নীল যন্ত্রণা


পু দিকের খোলা জানালার পর্দার ফাঁক গলে সকালের সূর্যের রোদ এসে চোখে পড়ায় ঘুম ভাঙে আসাদের। অবসাদগ্রস্ত চোখ জোড়া দুহাত দিয়ে একটু রগড়ে নিয়ে দেয়ালঘড়িটার দিকে চোখ বুলায় সে। আটটা দশ! অথচ ঠিক আটটায় অন্তরার সাথে দেখা করার কথা ওর। কী একটা জরুরি কথা বলবে বলে ওর কলেজের সামনে দেখা করার জন্য একটা চিরকুট পাঠিয়েছে গতকাল। কিন্তু আসাদ এখন কী করবে!
রুম থেকে বেরিয়ে অন্তরার কলেজের সামনে পৌঁছতে পৌঁছতে নটা বেজে যাবে নিশ্চয়। ততক্ষণে অন্তরা ওর জন্য অপেক্ষা করে করে ফিরে যাবে। কিন্তু আসাদের দোষটা কোথায়! রাত একটায় অফিস থেকে ফিরে টেবিল ল্যাম্পটা অফ করে চোখ বুজল। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বারবার শুধু একটি দুশ্চিন্তাই এসে ভর করছিল মাথায়। কী কারণে অন্তরা এত জরুরি তলব করল! কী এমন কথা! তবে কি কোনো দুঃসংবাদ!
বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িটা দুবার পিঁ পিঁ করে জানান দিল দুটা বেজে গেছে। সমস্ত দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ঘুমোবার চেষ্টা করল আসাদ। কিন্তু ঘুম আসছে কই! বারবার শুধু একটি মুখ ভেসে উঠতে লাগল চোখের সামনে। সুন্দর-নিষ্পাপ একটা মুখ। মুখটা অন্তরার। এরই মধ্যে হাতঘড়িটা আবার পিঁ পিঁ করে উঠল। এবার তিনবার। রকম করতে করতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল আসাদ।
বিছানা ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় পরে নিল সে। টেবিলের ওপর রাখা জগ থেকে দুগ্লাস পানি খেয়ে দরজার ছিটকিনি খুলতে যাবে এমন সময় খটখট করে শব্দ হলো দরজার অপর প্রান্ত থেকে। দরজা খুলে মুহূর্তের জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল আসাদ। অন্তরা দাঁড়িয়ে দরজায়। আসাদ স্বাভাবিক হওয়ার আগেই অন্তরা গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে-তা আমার জন্য নাকি সাহেবের রাতে ঘুমই হয় না। এভাবেই বুঝি আটটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমার কথা চিন্তা করা হয়!
প্রথমটায় কোনো জবাব খুঁজে পায় না আসাদ। পরে অনেক কষ্ট করেও অন্তরাকে বোঝাতে পারে না মূল ব্যাপারটা।
রুমে ঢুকে কাঠের চেয়ার টেনে বসে পড়ে অন্তরা। চুপচাপ কেটে যায় কয়েকটি মুহূর্ত। একসময় নীরবতা ভাঙে অন্তরা-
: বাবা-মা আমার জন্য ছেলে দেখছে। কাল মা আমার কাছে জানতে চেয়েছিল আমার কোনো পছন্দের ছেলে আছে কি না, মানে আমি কাউকে ভালোবাসি কি না।
: তুমি কী বললে?
: আমি তেমন কিছুই বলিনি। তবে আমি চাই তুমি নিজে বাবা-মার কাছে সরাসরি বলবে। আমার বিশ্বাস তোমাকে তাদের অপছন্দ হবে না।
: কিন্তু মুহূর্তে বিয়েটা কি...
: তার মানে, তুমি কী বলতে চাও?
: বলছিলাম, কিছুদিন পরে না হয়...
আসাদের কথা শুনে অন্তরা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায়।
: কোথায় যাচ্ছ! বসো। চা আনছি। বলে আসাদ।
ওর দিকে আর একবারও না তাকিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায় অন্তরা। কিছুই বলতে পারে না আসাদ। শুধু চেয়ে থাকে ওর চলে যাওয়ার দিকে।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্নালিজমে মাস্টার ডিগ্রি নিয়ে বেরুনোর কয়েক মাস পরেই একটা দৈনিক পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু আসাদের। এর ঠিক ছমাস পরই অন্তরার সাথে পরিচয় ওর।
অফিসে বসে একটা রিপোর্ট তৈরি করছিল আসাদ। এমন সময় টেলিফোন আসে একটা। রিসিভার হাতে নেয় আসাদ।
: আসাদ বলছি।
: আমি অন্তরা।
: জ্বী, মানে অন্তরা নামে আমি কাউকে...
: চেনেন না, তাই তো? কিন্তু আমি বলছি আপনি আমাকে দেখেছেন এবং চেনেনও।
: দেখুন, আমি জানি না আপনি আমাকে কীভাবে এবং কতটা চেনেন। তবে আমার দিক থেকে বলতে পারি, ঢাকা শহরে টেলিফোন করার মতো আমার কেউ নেই। হেঁয়ালি রেখে যদি কিছু বলার থাকে তো বলুন।
: প্লিজ রাগ করবেন না। শুনুন তবে, শিল্পকলা একাডেমীতে গত রোববারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ওপর একটা ফিচার ছাপা হয়েছে আপনাদের পত্রিকায়। অনেক কষ্টে জানতে পারলাম ওটা আপনারই লেখা। আর আপনি ওই লেখাটায় শুধু শুধুই আমার খুব বেশি প্রশংসা করেছেন।
: দেখুন অন্তরা, আমার স্মৃতিশক্তির ওপর ভরসা রেখে বলতে পারি, প্রশংসা তো দূরে থাক আপনার নামে ওখানে কিছু লেখাই হয়নি, আর সবচেয়ে বড় কথা আপনাকে আমি এখনও চিনছি না।
: তারপরও ওই লেখাটায় আপনি ইয়াসমিন নামের একটি মেয়ের কথা এত বাড়িয়ে লিখেছেন যে-
: মিথ্যা বা বাড়িয়ে বলার অভ্যাস আমার মোটেই নেই। তবু আপনার কথামতো যদি বাড়িয়ে লিখেই থাকি তো তাতে আপনার কী?
: কারণ আমিই সেই ইয়াসমিন। অন্তরা ইয়াসমিন। আপনজন অন্তরা বলেই ডাকে।
: বিশ্বাস হচ্ছে না।
: প্রমাণ পেলে বিশ্বাস করবেন তো! তবে তার আগে সত্যি করে বলুন, সেদিনকার গান আপনার সত্যি সত্যি ভালো লেগেছে কি না।
: আগেই বলেছি, মিথ্য বলার অভ্যাস আমার একদম নেই।
: বেশ। এবার প্রমাণ নিন।
: কীভাবে?
: ইয়াসমিনের গান শুনুন অন্তরার গলায়-
     মরণ যেদিন আসবে আমার
     কাঁদবে সবাই কাঁদবে জানি
     দাঁড়িয়ে আমার শিয়রে তুমি
     গেয়ো তোমার সে-গানখানি...
কী, এবার বিশ্বাস হলো তো?
: হলো।
কী যে হয় আসাদের, তন্ময় হয়ে অন্তরার গান শুনতে থাকে সে।
নীরবতা ভাঙে অন্তরাই : আসাদ ভাই, আপনার সাথে দেখা করতে ইচ্ছা হচ্ছে ভীষণ। সময় পেলে আসুন না একদিন বাসায়।
: না বাসায় নয়, অন্য কোনোখানে।
: কখন আসবেন?
: আপনার যখন ইচ্ছা। উত্তর দেয় আসাদ।
: ঠিক আছে। কাল বিকাল পাঁচটায় এলিফ্যান্ট রোডের কফি হাউজে। চিনে নিতে পারবেন তো আমাকে?
: অবশ্যই।
সেদিনকার মতো এখানেই আলোচনা শেষ হয় ওদের। পরের তিনটি মাস কেটেছে ওদের কিছুটা বাস্তবে আর বাকিটা কল্পনায় একে অন্যের হাত ধরে হাওয়ায় উড়ে উড়ে।
অন্তরা চলে যাওয়ার পর সারা দিন অস্থিরতায় কাটে আসাদের। সন্ধ্যায় কপালে হাত দিয়ে নিজেই অনুভব করে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। এর পরের সাতটি দিন কীভাবে গেছে নিজেই বলতে পারবে না আসাদ। কদিন কাজের বুয়াই দেখাশোনা করেছে ওর। অফিসের লোকজন এসে ডাক্তার দেখিয়েছে। খোঁজখবর নিয়েছে। কাজের বুয়ার কাছ থেকে জেনেছে, এর মধ্যে অন্তরা একবারের জন্যও খোঁজখবর নেয়নি ওর।
অসুখের ঘোর কিছুটা কাটতেই সব কিছু মনে পড়ল আসাদের। অন্তরার কথা মনে পড়ল। ওর চলে যাওয়ার কথা মনে পড়ল। আর বিছানায় থাকতে পারল না আসাদ। শরীর টেনে তুলতে কষ্ট হচ্ছে। তবু তাকে যে উঠতেই হবে। অন্তরাদের বাড়ি যেতে হবে। ওর বাবার কাছে বলতে হবে। নিজেকে নিজে বড় বলে ভাবতে থাকে আসাদ। বাড়ি-গাড়ি, অনেক টাকা-পয়সা না হয় না- থাকল, তবু ছেলে হিসেবে কম কিসে! লেখাপড়া করেছে। সত্-সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে নিজেকে।...
ভাবতে ভাবতে নিজের বাসার সামনের রাস্তায় এসে পড়ে আসাদ। এমন সময় আসাদের অনেক দিনের চেনা সেই চকলেট রঙের গাড়িটা ওর সামনে এসে ব্রেক করল। যে গাড়িটা দেখলে এতদিন খুশিতে নেচে উঠত মনটা। আজও ওর রোগা পাণ্ডুর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। ওইতো, এখনই কালো গ্লাসের দরজাটা ঠেলে বেরিয়ে আসবে অন্তরা। আসাদ ভুলে যাবে ওর কদিনের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট। কিন্তু না, গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভারই শুধু বেরিয়ে আসে। আসাদের দিকে বাড়িয়ে দেয় একটি নীল খাম।
খাম খুলতেই একটা কার্ড বেরিয়ে আসে। তড়িঘড়ি করে চোখ বুলায় আসাদ।
কী! নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারে না সে। মাথাটা চরকির মতো ঘুরতে থাকে যেন।

[রচনাকাল : ১৪০৩ বঙ্গাব্দ]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন