সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১২

কুয়াশা ঢাকা দিন : পর্ব-৫

পর্ব-
ভোরবেলা থানা থেকে পালিয়ে এসে শিশির ওদের বৈঠকখানায় ঢুকে ঘুম দিলো। ঘুম থেকে উঠে বাসার কেউ টের পাওয়ার আগেই বই খাতা নিয়ে স্কুলের দিকে ছুটলো।
শিশিরদের বাসার একমাত্র ঘড়িটা ওর বাবা সকালবেলাই হাতে দিয়ে বেরিয়ে যান বলে ওরা কখনও ঘড়ি দেখে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায় না। ওদের পরিবারে ঘড়ির বিকল্প হিসেবে যে যন্ত্রটা কাজ করে সেটা হলো একটা ট্রানজিস্টর রেডিও। সেটা থাকে বাবার রুমে কাঠের টেবিলটার ওপর। রেডিওটা খুললেই ওরা বুঝতে পারে কটা বাজে।
সকালবেলা রেডিওতে খবর শুনতে পেলে ওরা বুঝে নেয় নয়টা বেজেছে। জীবনটীকা শুনলে বুঝে যায় নটা পাঁচ পেরিয়ে গেছে। যদি রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে তাহলে বোঝে সাড়ে নটা, আর নজরুলসঙ্গীত চলতে থাকলে বোঝা যায় যে পৌনে দশটা বেজে গেছে। কিন্তু আজ আর শিশির বেতার যন্ত্রটার কাছে গেলো না সময় জানার জন্য। ওদিকে আকাশে মেঘ ছিলো বলে সূর্য দেখে আন্দাজ করারও উপায় ছিলো না। তাই ওসব দিকে চিন্তা না করেই শিশির ছুটলো স্কুলের দিকে।
ইচ্ছা ছিলো রবিনের সঙ্গে আজ আরও খোলাখুলি আলাপ করবে। কিন্তু বাসা ছেড়ে কিছুটা সামনের দিকে হাঁটতেই ভুল ভাঙলো তার। ওদের স্কুলের ইউনিফর্ম পরা অন্যসব ছেলে স্কুল থেকে বাড়ির দিকে ফিরছে। মুহূর্তে নিজের ভুল বুঝতে পারলো শিশির। গত রাতে না ঘুমানোয় লম্বা ঘুম দিয়ে উঠেছে শিশির। ততোক্ষণে সকাল-দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়েছে। রবিনের সঙ্গে দেখা হলো না বলে মন খারাপ হলো তার।
এদিকে শিশিরের বাবার চিন্তা হঠাত্ করেই বেড়ে গেলো অনেক। তার বড় ছেলে, মানে শিশিরের দাদা সুব্রত, পড়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। ভার্সিটি তো বন্ধ হয়েছে সেই কবে। কিন্তু সুব্রত আজও বাড়ি ফেরেনি।
ছেলে বাড়ি ফেরেনি অথচ সে নিয়ে শিশিরের বাবার কোনো মাথাব্যথা এতোদিন ছিলো না। তার চিন্তা শুরু হয়েছে স্থানীয় শান্তি কমিটির এক লোক সেদিন শিশিরদের বাড়িতে আসার পর থেকে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রূপনগরে আসার খবরে বাবার সে টেনশন কেনো আরও বেড়ে গেছে তা অন্য কেউ না বুঝলেও শিশির ঠিকই বুঝতে পারলো।
বুঝতে পেরে গর্বে ভরে উঠলো শিশিরের মন। সুব্রতদাকে একটু অন্যরকম ভালোবাসে শিশির। ছোটবেলা থেকেই শিশিরের যতো বায়না আবদার সব তার দাদার কাছেই। আর সব সময় চাইতেও হয় না। দাদা যে কী করে বুঝতে পারে শিশিরের কখন কী দরকার! গতবার তো ভার্সিটি থেকে ছুটি পেয়েই আস্ত একটা দুই নম্বর ফুটবল নিয়ে হাজির। পেয়ে কী যে খুশি হয়েছিলো শিশির! দাদা বলেছিলেন প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে ফুটবলটা পায়ে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করার জন্য। তাতে ফুটবল ট্যাকলিং যেমন শেখা হবে, তেমনি প্রতিদিনকার ব্যায়ামটাও হয়ে যাবে।
ফুটবলের কথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে হলো রবিনের।
অনেকদিন আগে একবার দাদার সঙ্গে দাদার স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়েছিলো শিশির। এখন অবশ্য সেই স্কুলটাই শিশিরদের স্কুল। আর সুব্রতদা তো স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে কিছুদিন লেখাপড়া করে ঢাকা ভার্সিটিতে গিয়ে ভর্তি হয়েছেন।
খেলা চলছিলো স্থানীয় টাউন ক্লাব আর জুয়েলস ক্লাবের মধ্যে। ফাইনাল খেলা। টাউন ক্লাবের খেলোয়াড়রা খুব ভালো খেলছিলো কিন্তু জুয়েলস ক্লাবের বাদল গুলির কারণে গোল দিতে পারছিলো না। গোলকিপারকে ওরা গুলি বলে। পারবে কীভাবে! বাদল গুলি এতোটাই লম্বা যে তার মাথাই প্রায় বারপোস্টে গিয়ে ঠেকে। আর দুদিকে দুহাত বাড়ালে মনে হয় গোলপোস্ট পুরোটাই আগলে আছে বাদল গুলি। একটা বল যাওয়ার জায়গাও নেই কোনোখানে।
তো হঠাত্ কী একটা ব্যাপার নিয়ে দুপক্ষের খেলোয়াড়দের মধ্যে শুরু হয়ে গেলো হাতাহাতি। তারপর তো সে কী মারামারি! যে যাকে সামনে পাচ্ছে কিল ঘুসি থাপ্পড় মারছে। সেই মারামারির মধ্যে শিশির দৌড়াবে কী, সে প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলো। তখন দাদা ওকে কাঁধে তুলে নিয়ে দৌড়ে পালালো।
আরেকবার নিজের পকেটের তিন-তিনটে টাকা খরচ করে একটা স্লেট-পেন্সিল আরআগে পড়িনামে একটা বই কিনে দিয়েছিলো। সেই বই পড়ে শিশির লিখতে শিখেছিলো। তারপর নিজের নাম লিখতে পারার আগেই সুব্রত নামটা লিখতে শিখেছিলো শিশির। লিখে দাদার টেবিলে এক টুকরো গ্লাসের নিচে চাপা দিয়ে রেখেছিলো। দেখতে পেয়ে দাদাও যে কী খুশি হয়েছিলো! সেদিন থেকেই সুব্রত আর শিশির দুজন মিলে একপ্রাণ হয়ে গেলো।
সেই দাদা শিশিরকে না নিয়ে, এমনকি না জানিয়ে যুদ্ধে চলে গেলো! এতে শিশিরের একটু অভিমানও হলো দাদার প্রতি। কেন, ওকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে কী হতো? শিশির যে আর আগের সেই ছোট্টটি নেই সেটা কি জানে না দাদা!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন