সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১২

কুয়াশা ঢাকা দিন : পর্ব-৪

পর্ব-
পরদিন স্কুল পালালো রবিন। বাসা থেকে বই খাতা নিয়ে বের হলেও ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করলো না তার।
প্রথমে ঘোষেদের বাগানে গিয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। মনে মনে আশা করেছিলো আজ হয়তো ক্লাসের আগেই শিশির এখানে আসবে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য।
কিন্তু না, শিশির এলো না।
ক্লাস শুরু হওয়ার আগে আগেই বাগানের পিছনের রাস্তা দিয়ে পালালো রবিন। স্কুলের বই খাতা রেখে দিলো একটা ঝোপের মধ্যে। স্কুলের সময় বই খাতা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে লোকজন হয়তো সন্দেহ করবে। ভাববে ছেলেটা নিশ্চয় স্কুল পালিয়েছে।
বাগান পেরিয়েই একটি মাটির রাস্তা। রাস্তাটি গ্রামের দিক থেকে এসে ডানদিকে বেঁকে স্কুলের সামনে দিয়ে চলে গেছে বাজারের দিকে। সোজাসুজি একটা রাস্তা গেছে থানার দিকে।
থানার দিকের রাস্তাটি একটু নিরিবিলি। বাজারের দিকের রাস্তাটিতে সব সময়ই লোকজন গিজগিজ করে। সময় বাজারের দিকের রাস্তায় যাবে না বলে ঠিক করলো রবিন। তাই সে ডান দিকের পথে না গিয়ে সোজা হাঁটতে লাগলো। সোজা রাস্তা ধরে কিছুটা হাঁটলে বাঁদিকে আরও একটি মাটির রাস্তা চলে গেছে সোজা অনেক দূরে। এই রাস্তাটিই রবিনের দাদাবাড়ি যাওয়ার পথ।
দাদাবাড়ির কথা মনে পড়তেই রবিনের সারা গা শিরশির করে উঠলো। চার বছর আগের কথা। রবিন তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। প্রাইমারি স্কুল ছেড়ে হাই স্কুলে ভর্তি হয়েই রবিনের মনে হয়েছিলো সে এখন অন্য এক মানুষ। এখন আর ছোটটি নেই সে।
সেবার ওরা গিয়েছিলো দাদাবাড়ি বেড়াতে। একদিন দুপুরে তেঁতুলগাছের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় কী ভয়টাই না পেয়েছিলো সে-সে কথা মনে হলে যখন তখন শিরশির করে ওঠে ওর গা।
রাস্তার পাশের তেঁতুলগাছটায় যে ভূতের আস্তানা আছে সে কথা শুধু রবিন নয়, গ্রামের সবাইই জানতো। জানতো এবং সেই সঙ্গে বিশ্বাসও করতো। বড়দের মধ্যেও অনেকে একা একা তেঁতুলগাছটির নিচ দিয়ে যেতে চাইতো না। গ্রামের কেউ কোনোদিন না দেখলেও অনেকেই বিশ্বাস করতো তেঁতুলগাছের ভূতটির কথা। বিশ্বাস করতো না শুধু একজন। সে হলো রবিনের চাচাতো ভাই বশির।
সেদিন দুপুরবেলা রবিন হাঁটছিলো তেঁতুলগাছটির নিচ দিয়ে। ওই সময় নির্জন পথে একা একা হাঁটতে ভয় লাগার কথা রবিনের। কিন্তু যে ছেলে প্রাইমারি পাস করে হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে সে কেন ভূতের ভয় পাবে? বেশ সাহস নিয়েই রবিন গাছটিকে প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছিলো।
কিন্তু না, শেষটা খুব মধুর হলো না।
হঠাত্ করেই তেঁতুলগাছটির একটি ডাল ঝরঝর ঝরঝর করে নড়ে উঠলো। তার ওপর অনেকগুলো তেঁতুল তার ডানে বাঁয়ে সামনে পিছনে ছড়িয়ে পড়লো। ঘটনাটা এমন আচমকা ঘটলো যে রবিনের ভয় পাওয়া উচিত কি না চিন্তা করার সময়ও পেলো না সে।
রবিন ভয় পেয়ে গেলো।
ভয় পেয়ে দৌড় দিতেই তার পিছনে ঝপাত্ করে একটা শব্দ হলো। সেই শব্দে রবিনের ভয়ের মাত্রা এবং দৌড়ের গতি দুটোই বেড়ে গেলো। এমন সময় পিছনে বশিরের গলা শুনে সে থমকে দাঁড়ালো।
বশির সেদিন বলেছিলো, কী রে রবিন, তুই নাকি সৈনিক হবি? এইটুকুতেই এতো ভয় পেয়ে গেলি!
এখন রবিনের মনে হচ্ছে সেদিন সে কতোই ছোট ছিলো। আর এখন? এখন তো রবিন কতো লম্বা হয়েছে। দাদু একবার বলেছিলেন, তোর মাথায় একটা পাথর চাপা দিয়ে রাখিস। নইলে মাথাটা একসময় আকাশ ছোঁবে কিন্তু।
তা রবিন ওর বন্ধুদের সবার চেয়ে লম্বাই শুধু নয়, বলা যায় অনেক লম্বা। আর সাহস? সে একবার যুদ্ধে যেতে পারলে দেখা যাবে। পাকিস্তানি সৈন্যদের একেকটাকে ধরবে আর ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে কল্লা কাটবে।
এসব ভাবতে ভাবতে কোন সময় যে রবিন ওর দাদাবাড়ির পথে হাঁটা শুরু করেছে নিজেও খেয়াল করেনি। শুধু হাঁটাই শুরু করেনি, মনে মনে হিসাব কষে দেখলো রবিন, দেড় মাইল রাস্তা সে পেরিয়ে এসেছে।
রবিনদের বাসা থেকে ওদের দাদাবাড়ির দূরত্ব তিন মাইল। সেই পথের মাঝ ধরা হয় জায়গাটিকে। এই তিন মাইল পথ যারা হেঁটে পাড়ি দেয় তারা জায়গায় এসে মনে করে-অর্ধেক পথ এসে গেছি তাহলে।
একটি রিজার্ভ পুকুরের পাশেই একটি ছোট্ট দোকান রয়েছে এখানে। রিজার্ভ পুকুর মানে সংরক্ষিত পুকুর। মানে পুকুরের পানি খাওয়ার জন্য সংরক্ষণ করা হয়। গ্রামের মানুষ বহু দূর থেকে কলস ভর্তি করে খাওয়ার জন্য পুকুরের পানি নিয়ে যায়। এইসব পুকুরে কেউ গোছল করা তো দূরের কথা, হাত-পাও ভিজায় না।
দোকানের সামনে একটি বেঞ্চ। দুটি খুঁটি পুঁতে তার ওপর একটি তক্তা পেরেক মেরে আটকে দেওয়া হয়েছে। অর্ধেক পথ হেঁটে আসার পর একটু দম নেওয়ার জন্য লোকজন এই বেঞ্চে বসে একটু জিরিয়ে নেয়। বেঞ্চের পাশেই একটি মাটির বড় মটকিতে পাশের পুকুরের ঠাণ্ডা টলটলে জল। গলার সঙ্গে রশি দিয়ে বাঁধা একটি অ্যালুমিনিয়ামের মগ। ক্লান্ত পথচারীরা বেঞ্চে বসে দুমগ পানি খেয়ে নেয়। তারপর কেউ ইচ্ছা হলে দোকান থেকে চারআনার গজা কিনে খায়। কেউবা দুই পয়সার পাতার বিড়ি কিনে দোকানে রাখা ফাইভস্টার ম্যাচলাইট দিয়ে ধরিয়ে ফুঁকতে থাকে।
আজকাল রূপনগর কলেজে পড়তে যাওয়া কিছু ছেলেও রাস্তায় চলাচল করে। তাদের জন্য দোকানদার এক প্যাকেট স্টার সিগারেট রাখে।
কেউ তার দোকান থেকে কিছু কিনলো কি কিনলো না সেদিকে দোকানির খুব একটা খেয়াল নেই। তবে যে কেউ তার দোকানের সামনে বসে দুমগ পানি খেলে সে খুব খুশি হয়। আর বসে যদি কতক্ষণ গল্প করে তবে তো কথাই নেই।
পায়ে পায়ে দোকানটার দিকে এগিয়ে গেল রবিন। ইংলিশ প্যান্টের পকেট হাতড়ে চানতারা মার্কা একটি তামার পাঁচ পয়সা দিয়ে দোকানদারের কাছ থেকে একটি স্টার সিগ্রেট কিনলো সে। সিগারেটটা ধরিয়ে খুব গর্ব গর্ব ভাব নিয়ে কষে এক টান দিলো রবিন। হ্যাঁ, এবার নিজেকে সত্যিকারের বড় মানুষ বলে মনে হচ্ছে তার।
কিন্তু না গর্বের ভাবটা বেশিক্ষণ থাকলো না, সিগ্রেটে দ্বিতীয় টান দিতেই খকখক করে কেশে উঠলো সে।
এমন সময় ব্যস্ত এক পথচারী এসে থামলো দোকানের সামনে। সকালে রেখে যাওয়া ছোট্ট শিশিটায় চারআনার কেরোসিন নিয়ে এক্ষুনি বাড়ি ফিরবে সে। তার মুখেই রবিন জানতে পারে রূপনগর বাজারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এসেছে। রূপনগর থানার ঘাটে ছোট ছোট কয়েকটি লঞ্চে করে তারা এসে নামছে। এই খবর পেয়ে বাজার একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। লোকজন যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে।
সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে রবিনও পিছন ফিরে হাঁটা শুরু করলো। রূপনগর থানার কাছ দিয়েই তাকে বাসায় ফিরতে হবে। এখন সেখানকার কী অবস্থা কে জানে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন