সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১২

কুয়াশা ঢাকা দিন : পর্ব-১২

পর্ব-১২
মাঝরাত্তিরে মাঝি এসে দরজায় কড়া নাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেলো। ফখরুদ্দীন খান সাহেব আগে থেকেই সবকিছু গোছগাছ করিয়ে নিয়ে বারান্দায় বসে ছিলেন মাঝির অপেক্ষায়। দরজা খুললেন তিনি নিজেই।
-মিয়াভাই জাইগাই আছেলেন? ফিসফিস করে বললো জব্বার মাঝি।
-হ। আয়, ভিতরে আয়। কেউ দেখেনি তো?
-না, দেহে নাই। কেউ টেরও পায় নাই। আস্তে আস্তে বৈঠা বাইয়া আইছি।
-এক কাজ কর তুই, এই বোঝাগুলো নৌকায় উঠিয়ে চুপচাপ নৌকায় বসে থাক। আমি আসছি।
-তাড়াতাড়ি আইয়েন মিয়াভাই। ভাটা হইয়া গেলে উজান বাইয়া আউগান যাইবে না কিন্তু।
-তুই যা। আমি তাড়াতাড়িই আসছি।
জব্বার মাঝি বিছানাপত্র আর কাপড়চোপড়ের ব্যাগগুলো নিয়ে নৌকায় চলে যায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফখরুদ্দীন খানও সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সবার মনেই রবিনের কথা উঁকি দিলেও মুখ দিয়ে কেউ সে ব্যাপারে একটা কথাও উচ্চারণ করলো না। খালপাড়ে যাওয়ার পথের মোড়টা ঘোরার সময় সবাই একবার পেছন ফিরে বাসাটাকে দেখে নিলেন। আবার কবে ফিরতে পারবে তাদের সবার প্রিয় জায়গাটায় কেউ তা জানে না।
সবকিছু ঠিকঠাক মনে হলেও শেষ সময় ঝামেলা বাধালো রবিনের পোষা কুকুরটা-জিমি। সবাই উঠে পড়েছে নৌকায়। মাঝি নৌকা ছাড়ছে। এমন সময় খালপাড়ে চুপচাপ বসে থাকা জিমির দিকে চোখ পড়লো খান সাহেবের।
-একটু থাম জব্বার। বললেন খান সাহেব।
-ক্যান, কী হইছে মিয়াভাই? জব্বারের কণ্ঠে আতঙ্কের ছাপ।
-কিছু হয়নি। ইশারায় কুকুরটাকে দেখালেন ফখরুদ্দীন খান।
-রবিন চাচার কুত্তাটা! ওইডারেও নেবেন?
কথাটা বলেই রবিনের কথা মনে পড়লো জব্বার মাঝির। মিয়াভাই, রবিন চাচায় কই? হ্যারে তো দেখলাম না। হ্যায় যাইবে না?
খান সাহেবের সব ছেলেমেয়েই জব্বার মাঝিকে জব্বার চাচা বলে ডাকে। মাঝিও তাদর সবার নামের সঙ্গে চাচা যোগ করে ডাকে।
ফখরুদ্দীন খান ডানহাতের একটা আঙুল ঠোঁটে ছোঁয়ালেন। মানে চুপ করতে ইশারা করলেন।
রবিন এখন যাবে না। ওর কথা পরে বলবো তোকে। এখন ওর কুকুরটাকে কী করবো? বললেন খান সাহেব।
-কুত্তাটা নৌকায় লইবেন মিয়াভাই? সামনের ডরার ওপর খাড়া করাইয়া লই? জিজ্ঞেস করলো মাঝি।
-হ্যাঁ, উঠিয়ে নিয়ে আয়।
জব্বার মাঝি পাড়ে উঠে কুকুরটাকে কোলে করে নৌকায় তুলে আনার চেষ্টা করলো। কিন্তু না, নৌকায় উঠবে না জিমি। হয়তোবা রবিনকে নৌকায় উঠতে না দেখে তারও নৌকায় ওঠার আগ্রহ নেই। শেষে অনেক জোরাজুরি করলো মাঝি। কিন্তু কিছুতেই নৌকায় তুলতে পারলো না জিমিকে।
অন্ধকারের মধ্যেও মাঝি খেয়াল করলো জিমির চোখে জল। অবলা প্রাণীরা নাকি যে কোনো বিপদ-আপদের কথা আগে থেকেই বুঝতে পারে। তাহলে কি সামনে কঠিন কোনো বিপদ এসে হাজির হচ্ছে তাদের? মনে মনে ভাবলো মাঝি।
ফখরুদ্দীন খান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
এই কুকুরটা একেবারে বাচ্চা বয়স থেকেই রবিনের সঙ্গে সঙ্গে থাকে। দেশি কুকুরগুলোর চাইতে বেশ বড়োসড়ো কুকুরটা। গায়ের লোমগুলোও বেশ বড়ো বড়ো। অথচ চলাফেরায় নরম নরম একটা ভাব।
একদিন কোথা থেকে যে সে এসে রবিনের সঙ্গে জুটেছিলো কেউ বলতে পারে না। কুকুরের বাচ্চাটিকে পেয়ে প্রথমেই রবিন বেগুনগাছের পাতায় করে ভাত খাইয়েছিলো তাকে। বেগুনগাছের পাতায় করে ভাত খাওয়ালে নাকি পোষা প্রাণীরা ভালো পোষ মানে। রবিনের মা বলেছিলেন কথাটা।
বেগুনপাতায় ভাত খাওয়ানোর জন্যই কি না কে জানে, সত্যি সত্যিই খুব পোষ মেনেছিলো কুকুরটা। অনেক ভেবে রবিন ওর নাম রেখেছিলো জিমি। রবিনের বাবা তখন বলেছিলেন, বেছে বেছে অতো বড়ো একজন লোকের নামটা পছন্দ করলি কুকুরটার জন্য? রবিন বলেছিলো, হোক বড়মানুষের নাম, আমার জিমি তার চেয়ে কম কীসে?
ধীরে ধীরে এমন অবস্থা হলো যে কুকুরটা রবিনের সঙ্গ ছাড়া থাকতোই না বলতে গেলে। প্রতিদিন সকালবেলা রবিন নিজের হাতে তাকে খাবার না দিলে খেতো না সে। তারপর রবিন যখন স্কুলে যেতো তখন স্কুলের গেট পর্যন্ত রবিনের সঙ্গে সঙ্গে যেতো জিমি। সবচেয়ে অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, স্কুল ছুটির সময়ও ঠিক ঠিক স্কুলগেটে উপস্থিত থাকতো জিমি।
একবার রবিনের হাত কামড়ে দিয়েছিলো জিমি। তখন জিমিও খুব ছোটো। পাশের বাসার নেড়ি কুত্তাটার সঙ্গে কামড়াকামড়ি করছিলো। ছাড়াবার জন্য মাঝখানে পড়ে গিয়েছিলো রবিন। ছোট্ট জিমি রাগ সামলাতে না পেরে কামড় বসিয়েছিলো রবিনের হাতে। ডাক্তার আসা পর্যন্ত রবিনকে শুইয়ে রাখা হয়েছিলো লিচুগাছটার নিচে ইজিচেয়ারে। কিছুক্ষণ পর কুকুরটাও এসে বসেছিলো রবিনের পাশে। সে হয়তো তার ভুল বুঝতে পেরেছিলো। কুকুরটার চোখে জল দেখে সেদিন আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন রবিনের বাবা।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে নৌকা ছাড়ার ইঙ্গিত করলেন খান সাহেব। জব্বার মাঝি নৌকা ছেড়ে দিলো। কুকুরটা বসে রইলো চুপচাপ। সে নড়লোও না চড়লোও না। তার চোখ থেকে শুধু অঝোর ধারায় ঝরে পড়তে লাগলো বেদনার অশ্রু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন