ভয়ে
কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরলো
আবির। আবিরকে দেখে প্রথমেই চিত্কার করে উঠলো
ওর ছোটো বোন
মিতু। মা, ভাইয়া,
দেখে যাও, ছোটোদাদার কী যেনো হয়েছে।
মিতুর
চিত্কারটা এমনই ভয়ঙ্কর ছিলো যে প্রায়
সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িতে যে যেখানে ছিলো দৌড়ে এসে
হাজির হলো আবিরদের ঘরের বারান্দায়। মা এলেন,
ভাইয়া এলো, ছোটোমামা এলো, কাজের লোকজনও কেউ বাদ গেলো
না। এমনকি ওদের
বাড়ির আশপাশের বাড়িঘর থেকেও ছুটে
এলো অনেকে।
ছোটোমামা এসেই প্রথমে জড়িয়ে ধরলো
আবিরকে। জড়িয়ে ধরেই
বুঝতে পারলো তখনও
ভয়ে কাঁপছে আবির। দেরি
না করে কোলে
তুলে নিলো সঙ্গে
সঙ্গে। মা এসে
আবিরের পিঠে ছোট্টো করে দুটো থাপ্পর দিলেন-এতে নাকি
ভয় কেটে যায়।
কাজের মেয়ে রহিমা
ছুটে এলো এক
চিমটে লবণ নিয়ে।
আবিরের হাতে লবণটুকু দিয়ে বললো, বাম
হাতের তালুতে লইয়া একবারে খাইয়া ফালান বাইজান, ডর বয় সব
কাইট্টা যাইবো গা।
কিন্তু না, কিছুতেই কিছু হলো
না, আবির যেমনটি ছিলো ঠিক তেমনটিই রইলো। সেই সন্ধ্যায় ভয়ে যেমনটা চুপসে গিয়ে
বাড়ি ফিরেছিলো তেমনই চুপসে
রইলো সে। কাউকে
কিছু বললো না,
কিছু খেলো না,
এমনকি চারদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলোও না কে
কে আছে তার
চারপাশে। কখনও ছোটোমামার কোলে, আবার কখনও
মায়ের কোলে মুখ
গুঁজে পড়ে রইলো
সে।
রাতে
আর কোনো কথা
বললো না আবির।
মায়ের বুকের সাথে
মিশে বেহুঁশের মতো ঘুমিয়ে রইলো সারা রাত।
পরদিন
প্রচণ্ড জ্বর এলো
তার। বাবা ডাক্তার ডেকে আনালেন। অনেক পরীক্ষা-টরীক্ষা করে ডাক্তার ওষুধ দিলেন। কিন্তু জ্বর কমলো
না।
কবিরাজ এলো। সেও গাছের
শিকড়-বাকড় ছেঁচে-বেটে ওষুধ
বানিয়ে দিলো। কিন্তু জ্বর ছাড়লো না।
পাড়াপড়শিরা বলাবলি শুরু করলো,
নিশ্চয়ই ভূতে কিংবা
জিনে ধরেছে। নইলে ভালো
ছেলেটি বিকেলবেলা অন্য ছেলেদের সাথে খেলতে
গিয়ে এরকম হয়ে
ফিরে আসবে কেন!
অতএব
কেরামত ফকিরের ডাক পড়লো।
কেরামত ফকিরের এলাকায় খুব নামডাক। ভূত কিংবা জিন
তার পাল্লায় পড়লে আর
রক্ষা নেই। কেরামত ফকিরের পোষ মানা
জিন আছে অনেকগুলো। সে যা বলে
তাই তারা করে।
যে কোনো রোগের
ওষুধ থেকে শুরু
করে যে কোনো
সমস্যার সমাধান জিনেই করে
দেয়। কোনো বদজিন
বা ভূত যদি
কাউকে আছর করে
আর সেই জিন
বা ভূত যদি
কেরামত ফকিরের হাতে পড়ে
তাহলে তার ক্ষমা
নেই। এই গ্রামে আর আসবে না-এরকম প্রতিজ্ঞা করিয়ে তবেই ছাড়বে। তার আগে হলুদ
পড়া আর ঝাড়ুর
বাড়ি দিয়ে মেরে
মেরে শায়েস্তা করে ছাড়বে
তাকে।
তো,
কেরামত ফকির এসেই
ধ্যানে বসে গেলো।
সমস্ত বাতিটাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে ফেলা হলো।
জ্বালানো হলো আগরবাতি। ধুপ ধুনো পোড়ানো হলো। তারপর জিন
এসে নাকিগলায় কথা বলতে
লাগলো ফকিরের সঙ্গে। তারা বললো,
কাল মাঠে খেলার
সময় একটা বদজিনে ধরেছে আবিরকে। এই জিনটা
খুবই শক্তিশালী। একে শায়েস্তা করা খুবই কঠিন।
তবে যতো কঠিনই
হোক কেরামত ফকিরের কেরামতির কাছে সে
টিকতে পারবে না।
তবে একটু কষ্ট
করতে হবে। একটা
ছাগল বলি দিতে
হবে। তবেই এই
বদজিন ছেড়ে যাবে
আবিরকে আর আবির
হয়ে উঠবে পুরোপুরি সুস্থ।
ঠিক
হলো, পরদিন বাজার
থেকে বড়ো একটা
ছাগল কিনে দিয়ে
দেওয়া হবে ফকিরকে। সেটা বলি দিয়ে
ভূতদের খাওয়াবে ফকির। তারপর
ভূতেরা সব চলে
যাবে আবিরকে ছেড়ে। আবির
সুস্থ হয়ে উঠবে।
এদিকে
আবিরের ছোটোমামা এসবের কিছুই
বিশ্বাস করে না।
সে আবিরের ভয় পাওয়ার অন্য কারণ খুঁজতে লাগলো।
পরদিন
সেই মাঠে গেলো
ছোটোমামা, যেখানে খেলতে গিয়ে
আবির ভয় পেয়ে
ফিরে এসেছিলো। সেখানে গিয়ে জানতে
পারলো, সেদিন শুধু
আবিরই ভয় পায়নি,
তার আরও দুজন
সঙ্গী একইভাবে ভয় পেয়ে
বাড়ি ফিরেছে। তবে তাদের
অবস্থা এতোটা খারাপ
না। ভয়ে তারা
ওই মাঠে আর
খেলতে যাচ্ছে না ঠিকই,
কিন্তু আবিরের মতো অসুস্থ হয়ে পড়েনি তারা।
ভয়
পাওয়া অন্য ছেলে
দুটিকে অনেক কষ্টে
খুঁজে বের করলো
ছোটোমামা। তাদের কাছ
থেকেই জানতে পারলো
সেদিন কীভাবে ওরা ভয়
পেয়েছিলো।
আবিরদের বাসার কাছাকাছি পুরনো একটা
কবরস্থান। তার পাশেই
পড়ে রয়েছে বিশাল
একটা খালি জায়গা। যে খালি জায়গাটা আবির আর ওর
বন্ধুরা খেলার মাঠ
হিসেবে ব্যবহার করে। ফুটবল
খেলে, ক্রিকেট খেলে, কানামাছি-কাবাডি-গোল্লাছুট খেলে। আরও
কত কী!
সেদিন
বিকালে ওরা সবাই
সেই মাঠে ফুটবল
খেলছিলো। খেলার সময়
কে যেনো জোরে
এক শট নেয়
বলে। মাঠ পার
হয়ে বল গিয়ে
পড়ে কবরস্থানে। সঙ্গে সঙ্গে
দৌড়ে যায় আবির।
কারণ বলটা কুড়িয়ে আনতে পারলে থ্রুটাও সে-ই করতে
পারবে। তার পিছনে
ছিলো আরও দুজন।
পলাশ আর ফাহিম। কিন্তু বলটির কাছাকাছি গিয়েই চিত্কার করে ওঠে
আবির। চিত্কার শুনে থমকে
দাঁড়ায় ওরা দুজনও। তখনই ব্যাপারটা খেয়াল করে
পলাশ আর ফাহিম।
একটা
আগুনের কুণ্ডলী ঘুরপাক খাচ্ছে বলটিকে ঘিরে।
ব্যস,
এই পর্যন্তই। আর কিছু
দেখতে পায়নি ওরা।
আবির বলটির একেবারে কাছাকাছি ছিলো তাই
সে বেশি ভয়
পেয়ে যায়। পলাশ
আর ফাহিম একটু
দূরে ছিলো, ওরা
আবিরের চিত্কার শোনার পর
আলোটার দিকে খেয়াল
করে। আর তখনই
সেই আগুনের কুণ্ডলী হঠাত্ চলতে
শুরু করে। একসময়
কোথায় যেনো মিলিয়ে যায় সেটা।
পলাশ
আর ফাহিমের কাছ থেকে
এসব কথা শুনে
বাড়ি ফিরে আসে
মামা। বাড়ি ফিরে
আবিরকে বুকের মধ্যে
জড়িয়ে ধরে বলতে
শুরু করে সে-কাল কবরস্থানের কাছে তুমি যে
আগুনের কুণ্ডলীটা দেখেছিলে সেটা জিন
বা ভূত কিছুই
না। আসলে ওটা
ছিলো একটা আলেয়া। ফসফরাস আর হাইড্রোজেন মিলিত হয়ে আলেয়া
তৈরি করে। মানুষ
বা জীবজন্তুর শরীর বা
গাছপালা পচে তা
থেকে একরকম বাষ্প
তৈরি হয়। এই
বাষ্পের এমন স্বভাব যে বাতাসের স্পর্শে তা আপনা
থেকেই দীপ্তিমান হয়ে ওঠে।
কখনও কখনও তা
মশালের মতো জ্বলেও ওঠে। আবার কখনও
সঙ্কুচিত হয়ে দীপশিখার মতো জ্বলতে থাকে। কখনও
বাতাসের ধাক্কায় খণ্ড খণ্ড
হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
আবার কখনও কয়েকটি খণ্ড এক হয়ে
আরও বেশি আলো
ছড়াতে থাকে। আর
আশ্চর্য ব্যাপার যে, পানিতেও নেভে না এই
আলো। তাইতো অনেকে
ঝড়বৃষ্টির রাতে এরকম
আলোকশিখা দেখে জিন
বা ভূত মনে
করে ভয় পেয়ে
থাকে।
মামার
কথা শুনে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে
লাগলো আবির। তার
ভয় একেবারে কেটে না
গেলেও চোখ পিটপিট করে মামার দিকে
চাইতে লাগলো আবির।
মামা
বলে যেতে লাগলো,
তো কোনো মানুষ
যদি এই আলোর
কাছাকাছি আসে, তাহলে
মানুষের হাঁটাচলার জন্য বাতাসে যে চঞ্চলতা শুরু হয়
তাতে ওই আলোও
চঞ্চল হয়ে ওঠে।
বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে
আলেয়াও এদিক ওদিক
দৌড়াদৌড়ি শুরু করে।
আর মানুষ এতে
ভয় পায়। আমাদের দেশের মানুষদের মধ্যে এই
রকম কুসংস্কার আছে যে,
রাতের বেলা মানুষজনকে ভয় দেখানোর জন্য ভূতেরা এরকম আলোর বেশ
ধরে থাকে। আর
পথিকদের পেলেই তারা
এভাবে দৌড়াদৌড়ি করে ভয়
দেখায়। আসলে এসবই
আমাদের না জানার
ফল। আমরা যদি
এই ব্যাপারটুকু জানতাম তাহলে আর
আলেয়া দেখে ভয়
পেতাম না।
মামা
কথা থামাতেই ঝট করে
উঠে বসে আবির।
মামার চোখের দিকে
তাকিয়ে বলে, মামা,
তুমি যা বলছো
তা কি আসলেই
সত্যি, নাকি আমার
ভয় কাটাবার জন্য বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছো!
মামা
বললো, একদম সত্যি। বড়ো হয়ে লেখাপড়া করে এমনিতেই এসব জানতে
পারবে তুমি।
আবিরও
জানে, মামা কখনও
মিথ্যা কথা বলে
না। বরং মামা
আবিরকে যেসব গল্প
শোনায় তাও আসলে
বেশিরভাগই গল্প না।
আবিরকে শেখানোর জন্য বিজ্ঞানের নানা অদ্ভুত কাহিনী সে গল্প
বলে চালিয়ে দেয়।
মামা
বললো, আসলে তোমার
এভাবে ভয় পাওয়াটা ঠিক হয়নি। কোনো
কিছুর সম্বন্ধে পুরোপুরি না জেনে
তাকে ভয় পাওয়া
কোনো বুদ্ধিমান মানুষের কাজ নয়।
মামার
গলা জড়িয়ে ধরে
আবির বললো, আসলেই
মামা এভাবে ভয়
পাওয়াটা আমার একদম
ঠিক হয়নি। আজ
আবার আমি মাঠে
খেলতে যাবো। আর
দেখবো কোন ভূত
বা জিন আছে
সেখানে। আমার বন্ধুদেরও সব বুঝিয়ে বলবো। আর
যদি কোনো আলেয়ার দেখা পাই তাহলে
তাকে নিয়েও আমরা
অনেক মজা করবো।
ফসফরাস আর হাইড্রোজেন মিলিত হয়ে আলেয়া তৈরি করে।
উত্তরমুছুনছোটবেলায় গুলিশাখালি যেতাম যাত্রা দেখতে। তখন গ্রামের বাড়িতে থাকতাম। রাতে রাস্তায় চলতে চলতে আলেয়ার আলো দেখে খুব ভয় পেতাম। বিষয়টি যখন পরিষ্কার হয়েছে, তখন আর ভূতের ভয় নেই। তবে একটা বিষয় কিছুতেই মিলাতে পারি না। ছোটবেলায় একটি খেজুর গাছের মাথায় উঠেছিলাম- কী করে হলো ভাবতেই পারি না।
অন্ধকারের সঙ্গে ভূতের একটা সম্পর্ক থাকে। যতই অন্ধকার দূর হয়েছে, মনের এবং বাস্তবের, ততই ভূতেরা দূরে চলে গেছে।
উত্তরমুছুনআমি কোনোদিন আলেয়া দেখিনি। কিন্তু ২০০৭-এ সিডরের যে বর্ণনা শুনেছি সেখানে মনে হয়েছে আলেয়ারই অন্য এক রূপ উপস্থিত। সিডরের সেই বাস্তব কাহিনী নিয়ে গল্প ‘সিডর ২০০৭’।