বিশাল এক সাগর। বুকভরা তার জল। কত জল কেউ তা বলতে পারবে না। সেই জলের নিচে পলিমাটি জমতে জমতে একদিন মাথা তুলে দাঁড়াল বিরাট একখণ্ড ভূমি। লোকে বলে দ্বীপ। সাগরের বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে সে দ্বীপে। মাছেরা পাড়ে এসে খেলা করে। মাঝে মাঝে দুয়েকটা হাঙর এসে বসে থাকে। বসে বসে রোদ পোহায়। এছাড়া আর কিছুই নেই সেই দ্বীপে।
মানুষজন নেই।
গাছপালা নেই।
ঘাসপাতা নেই।
ফুলপাখি নেই।
প্রজাপতি নেই।
কিচ্ছু নেই।
একদিন একটি পাখি উড়ে যাচ্ছিল সেই দ্বীপের ওপর দিয়ে। হঠাত্ তার মুখ থেকে একটি ফল মাটিতে পড়ে যায়। দিনে দিনে সেই ফল শুকিয়ে তার ভেতর থেকে বের হয় একটি বিচি। তারপর বর্ষার পানিতে ভিজে সেই বিচি থেকে ছোট্ট একটি চারা গজায়। ধীরে ধীরে চারাগাছটি বড় হতে থাকে। পাতায় পাতায় ভরে যায় সেই গাছ। সেই গাছে বছর বছর ফুল হয়। কিন্তু ফল হয় না।
একদিন সাগরে ঝড় হল। প্রচণ্ড ঝড়। সে ঝড় বয়ে যেতে লাগল দ্বীপের ওপর দিয়ে। ঝড়ে গাছের পাতারা লুটোপুটি খেতে লাগল। একটু বেশি বয়সের হলুদ হলুদ পাতাগুলো উড়ে যেতে লাগল বাতাসের সাথে। শিকড়েরা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখল মাটি, যাতে পুরো গাছ উপড়ে যেতে না পারে।
এমন সময় একটি প্রজাপতি এল বাতাসে ভাসতে ভাসতে। গাছকে সে বলল, ভাই গাছ, বড় বিপদে পড়েছি। একটু আশ্রয় দেবে?
গাছ বলল, দেখতেই পাচ্ছ ঝড়ে নিজেই টিকতে পারছি না। তারপরও তুমি যখন বলছ দেখি চেষ্টা করে। এক কাজ করো তুমি, আমার এই মোটা ডালটার এপাশে এসে বসো। এদিকে বাতাসের ঝাপটা একটু কম। দেখো এবারের মতো বাঁচতে পারো কি না।
বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ায় শরীরে কাঁপন ধরে গিয়েছিল প্রজাপতির। কাঁপতে কাঁপতেই সে গাছের বড় ডালটার আড়ালে চলে এল। বড় ডালের আড়ালে জবুথবু হয়ে চুপচাপ বসে রইল সে।
ঠিক তখনই একটি রঙিন পাখি এসে আশ্রয় চাইল গাছের কাছে। গাছ তাকেও আশ্রয় দিল।
একসময় ঝড় থেমে গেল। যার যার আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এল প্রজাপতি আর রঙিন পাখি।
প্রজাপতি বলল, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। সমুদ্রের ওই পারে ফুলের মধু খেয়েটেয়ে একটু খোলা হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলাম। হঠাত্ কোথা থেকে ঝড় এল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই উড়তে লাগলাম বাতাসের সঙ্গে।
রঙিন পাখি বলল, মাছ খাওয়ার জন্য সমুদ্রের পানির ওপর চক্কর দিচ্ছিলাম। এমন সময় কোথা থেকে এল দমকা বাতাস। কী বলব ভাই, বাতাসের এমন তেজ জীবনেও দেখিনি। বাতাসে ভাসতে ভাসতে মনে হল হয়তো হাওয়ায় মিলিয়েই যাবো। ঠিক তখনই গাছের দেখা পেলাম।
গাছ বলল, ঝড়ে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমার অনেক ডালপালা ভেঙে গেছে। বেশিরভাগ পাতাই ঝরে গেছে।
ঝরে-যাওয়া পাতাদের কথা মনে পড়ায় মহা দুশ্চিন্তায় পড়ল গাছ। হায় হায়, সবজু পাতারা এতদিন গাছের জন্য খাবার জোগাড় করত। পাতার সবুজ ক্লোরোফিল সূর্যের আলোর সাহায্যে খাবার বানাত। সেই খাবার খেয়েই বাঁচত এত বড় গাছ। এখন পাতারা নেই। কে বানাবে তার জন্য এত খাবার! কীভাবে বাঁচবে সে!
গাছের শিকড় বলল, কোনো চিন্তা নেই। এতদিন আমিও তো মাটি থেকে অনেক খাবার জোগাড় করেছি। এখন থেকে না হয় একটু বেশি বেশি খাবার জোগাড় করতে হবে আমাকে। সে খাবার খেয়ে বেঁচে থাকবে গাছ। গাছ বেঁচে থাকলে নতুন নতুন পাতা জন্মাবে। নতুন পাতারাই একদিন খাবার জোগাড় করবে। তখন আর কোনো চিন্তা থাকবে না।
শিকড়ের কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেল গাছ। সে বলল, ঝড়ে পাখি-বন্ধুরও ডানার অনেকগুলো পালক ছিঁড়ে গেছে। কয়েকদিন হয়তো উড়তেও পারবে না সে। প্রজাপতি বন্ধুও তার ডানায় আঘাত পেয়েছে। এতকিছুর পরেও আমার কিন্তু অনেক আনন্দ হচ্ছে।
প্রজাপতি বলল, কেনো কেনো, সবার এত কষ্ট, তারপরও তোমার কেনো আনন্দ হচ্ছে?
বটগাছ বলল, এই যে তোমাদের মতো দুজন ভালো বন্ধু পেলাম, সে তো ঝড়ের কারণেই। তাই না? ঝড় না এলে তো তোমরা এখানে আসতেই না। আর আমরাও তিনজন বন্ধু হতাম না।
রঙিন পাখি বলল, ঠিক তাই।
এরপর থেকে গাছ, রঙিন পাখি আর প্রজাপতি হেসে খেলে, গান গেয়ে আর গল্প করে দিন কাটাতে লাগল।
দিনে দিনে বছর ঘুরে এল। শিকড়ের তৈরি খাবার খেয়ে বেঁচে রইল গাছ। তার ন্যাড়া ডালপালায় নতুন নতুন কুঁড়ি গজাল। আস্তে আস্তে পাতায় পাতায় আবার ভরে গেল গাছ।
একদিন ছোট্ট ছোট্ট সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটল গাছে। প্রজাপতি সেই ফুলে ফুলে ঘুরে ঘুরে মধু খেতে লাগল আর ফুলের রেণু গায়ে মেখে আনন্দে হইহই করতে লাগল। একসময় গাছে ফল হল। ফল দেখে গাছ নিজেই অবাক হলে গেল। এত বছর ধরে ফুল ফোটাচ্ছে সে। কিন্তু কোনোদিন ফল ধরেনি। এবার ফলে ফলে ভরে গেছে গাছ।
ছোট্ট ছোট্ট সবুজ সবুজ ফল দিনে দিনে পেকে টকটকে লাল হল। রঙিন পাখি মজা করে সে ফল খেতে লাগল। একদিন সে উড়তে উড়তে সমুদ্রের অন্য পারে চলে গেল। গিয়ে অন্যসব পাখিকে নতুন দ্বীপের কথা বলল। গাছের কথা বলল। ফলের কথাও বলল।
রঙিন পাখির মুখে এসব কথা শুনে অন্য পাখিরাও নতুন দ্বীপে এল রঙিন পাখির সাথে। তারা সবাই মজা করে ফল খেতে লাগল। ফলের বিচি মাটিতে পড়ে পড়ে অনেক চারা গজাল। সেসব চারা থেকে অনেক গাছ হল। গাছে গাছে সবুজ হয়ে উঠল নতুন দ্বীপ। নতুন আসা পাখিরা গাছে গাছে বাসা বানাল। ডিম পাড়ল। সেই ডিম ফুটে ছোট ছোট বাচ্চা হল। পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠল নতুন দ্বীপ।
গাছ বলল, এখন আর কোনো ভয় নেই। এখন আর আমি একা নই। আসুক যতো খুশি ঝড়। সবাই মিলে লড়ব সে ঝড়ের সঙ্গে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন