সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

শুক্রবার, ২০ এপ্রিল, ২০১২

শায়লা আর দোয়েল


শায়লা আপু, তাড়াতাড়ি ওঠো। আজ না তোমার ছোটমামা আসার কথা! সবই এয়ারপোর্টে যাচ্ছে। তুমি ঘুমিয়ে থাকলে তোমাকে না নিয়েই কিন্তু চলে যাবে সবাই।
শায়লার খাটের পাশেই একটা জানালা। সেই জানালার বাইরে বড় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। সেই গাছে সারাদিন কিচির-মিচির, ওড়াওড়ি, লাফালাফি করে বেড়ায় অনেক অনেক পাখি। সেইসব পাখির মধ্যে একটা দোয়েল পাখি শায়লার খুব প্রিয়। সময় পেলেই শায়লা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দোয়েল পাখিটার নাচানাচি দেখে। আর কী সুন্দর শিস্ দেয় পাখিটা! শুনলে আনন্দে নেচে ওঠে মন। ওরও ইচ্ছে করে ওরকম শিস্ দিয়ে গান গাইতে। কিন্তু পারে না। ছোটমামা বলেছে, দোয়েল নাকি আমাদের জাতীয় পাখি।
আরও একটা আশ্চর্য কাণ্ড করে পাখিটা। রোজ দুপুরে খাবারের পর ওদের শোয়ার ঘরের খটে কিছুক্ষণ ঘুমায় শায়লা। তখন দোয়েল পাখিটা জানালার খুব কাছের একটা ডালে এসে বসে। বসে কত রাজ্যির গল্প যে করে শায়লার সঙ্গে! বাব্বাহ, পাখিটা জানেও অনেক কিছু। আর জানবেই বা না কেন! পাখিদের তো আর শায়লার মতো বদ্ধ ঘরের মধ্যে থাকতে হয় না সারাদিন! উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখে ওরা। আর সেইসব মজার মজার কথা শায়লার কাছে এসে বলে সে। তবে আজব ব্যাপার হল, শায়লা যখনই চোখ মেলে চায়, অমনি দোয়েল পাখিটা চোখের পলকে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। আজও গেল।
মামা আসবে, সবাই এয়ারপোর্টে যাচ্ছেএইটুকু বলেই সে চোখের আড়ালে চলে গেল।
যাক, সময়মতো শায়লার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে এতেই খুশি সে।
শায়লা যখন এইসব চিন্তা করছে এমন সময় রুমে ঢুকল ছোটখালা। শায়লামণি, তাড়াতাড়ি ওঠো, এয়ারপোর্টে যাবে না! বলতে বলতে শায়লার দিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল সে। ওমা, মেয়ে দেখি আগেই চোখ মেলে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতিদিন সকালে যাকে একশোবার সোনামণি বলে ডেকে ডেকে, কপলে চুমু দিয়ে দিয়ে, চুলে হাত বুলোতে বুলোতেও ওঠানো যায় না, আজ সে কী করে এত সকালে সজাগ হল!  এতে খালামণি অবাক তো হবেনই।
যাক, তবু বাঁচা গেল। এমনিতেই এই ভোর সকালে রওনা হতে দেরি হয়ে যাচ্ছিল, তার ওপর শায়লাকে ওঠাতে দেরি হলে এয়ারপের্টে যেতে যেতে প্লেন হয়তো এসেই পড়ত।
জানো খালামণি, দোয়েল পাখিটা না এত সকাল সকাল ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে গেল আমার। ঘুম জড়ানো গলায় আধো আধো বোলে কথাগুলো বলল শায়লা।
দিন ধরে বেশ শীত পড়ছে। আজ বাইরে প্রচুর কুয়াশা। শায়লাকে গরম কাপড় পরাতে পরাতে খালা বলল, তা তোমার দোয়ের পাখি প্রতিদিন এসে তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে গেলে তো আমি বেঁচে যাই।
একটু থেমে খালামণি আবার বলল, শায়লামণি, পাখিদেরকে তো তুমি অনেক ভালোবাস, তাই না?
হ্যাঁ, তা তো বাসিই। জানো খালামণি, দোয়েল পাখিটা না আমাকে খু-- ভালোবাসে। দেখো না আমার সঙ্গে রোজ রোজ কত রাজ্যির গল্প করে! বলল শায়লা।
তুমি তো সারাদিন জানালায় বসে বসে পাখি দেখো, তাই দেখে তোমার আব্বু সেদিন খাঁচায় করে কী সুন্দর দুটো পাখি এনে দিয়েছে। কই, তাদের সঙ্গে তো তুমি কোনো গল্পই করো না। খালামণি বলল।
শায়লা বলল, না খালামণি, খাঁচার পাখি দুটোর কাছে যেতে আমার একটুও ভালো লাগে না। ওদেরকে দেখলে আমার খুব খারাপ লাগে। মনে হয় বদ্ধ খাঁচায় ওরা কেমন ছটফট করছে।
খালামণি আর কোনো কথা বলল না। এতক্ষণে শায়লার জামাকাপড় পরানো শেষ। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠল সবাই।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ছোটমামা প্রথমেই শায়লাকে কোলে তুলে নিল। শায়লাকে আদর করতে করতে আর অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গাড়িতে গিয়ে উঠল ছোটমামা।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে শায়লা খেয়াল করল রাস্তার দুদিকটা সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে আজ। গাঢ় সবুজের মাঝে টকটকে লাল বৃত্ত আঁকা পতাকা উড়ছে প্রতিটি অফিস আর বাড়ির সামনে। একই রকম ছোট ছোট কাগজের পতাকা সুতোর সঙ্গে আটকিয়ে এত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে পথের দুধার আর পথের পাশের বাড়িগুলো যে শায়লা অবাক হয়ে গেল। মনে হয় যেন পুরো ঢাকা শহরটা, নাকি পুরো দেশটাই আজ অন্যরকমভাবে সাজানো হয়েছে।
ছোটমামাকে জিজ্ঞেস করল শায়লা, ছোটমামা, সমস্ত রাস্তাঘাট আর বাড়িগুলো আজ এমনভাবে সাজানো হয়েছে কেন?
ছোটমামা বলল, কেন, জানো না তুমি! আজ ষোলোই ডিসেম্বর, আমাদের বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের ছাব্বিশে মার্চ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আমাদের দেশের সাধারণ নিরীহ মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেছিল। সেদিন এই দেশটাও ছিল পাকিস্তানের অংশ। তারা চেয়েছিল আমাদেরকে তাদের পরাধীন করে রাখতে। কিন্তু আমরা তা মানিনি। আমরা চেয়েছি স্বাধীনতা। আমাদের দেশের সাহসী লোকেরা তাদের সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করে জয়ী হয়েছিল। সে যুদ্ধে তিরিশ লাখ বাঙালি শহীদ হয়েছিল। নয় মাস যুদ্ধ শেষে ষোলোই ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা পরাজয় মেনে নেয় আর আমরা পাই স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা মানে কী ছোটমামা? শায়লা প্রশ্ন করে।
এমন সময় মা বলে, চুপ করো তো মামণি। মামা অনেক দূর থেকে এসেছে। আগে বাড়ি গিয়ে তাকে বিশ্রাম নিতে দাও। তারপর তোমাকে এসব গল্প শোনাবে।
শায়লা চুপ মেরে গেল। কিন্তু মনে মনে ভাবতে লাগল, স্বাধীনতা এমন কী জিনিস যার জন্য এত এত মানুষ জীবন দিতেও ভয় পায় না!
দুপুরের খাবার খেয়ে প্রতিদিনের মতো আজও শুয়ে পড়ল শায়লা। বইরে কৃষ্ণচূড়া গাছটা নতুন সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে। আর কদিন পরেই লাল ফুলে ফুলে ভরে যাবে গাছটা। তখন ফুলের ফাঁকফোকর দিয়ে কোথাও একটু সবুজ পাতাও দেখা যাবে না। আর দুপুরের রোদ এসে ফুলগুলোর ওপর পড়লে মনে হবে পুরো গাছটি যেন আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলছে। দেখে কী যে ভালো লাগবে শায়লার!
শুয়ে শুয়ে এসব কথা ভাবছিল শায়লা। এমন সময় তার বন্ধু দোয়েল এসে বসল জানালার পাশের সেই ডালটিতে।
দোয়েল এসেই মিষ্টি করে একবার শিস্্ বাজাল। তারপর বলল, শায়লা আপু, শায়লা আপু, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি!
না দোয়েল ভাইয়া, ঘুমুচ্ছি না, চিন্তা করছি। বলল শায়লা। কী এমন চিন্তা করছ তুমি? দোয়েল জিজ্ঞেস করল।
আমি চিন্তা করছি স্বাধীনতা মানে কী? যা পাওয়ার জন্য তিরিশ লাখ বাঙালি এমন নির্ভয়ে জীবন দিল!
দোয়েল বলল, তো সোজা একটা প্রশ্ন। স্ব মানে নিজ আর অধীনতা মানে অধীনে থাকা। স্বাধীনতা মানে হচ্ছে নিজের অধীনে থাকা। সোজা কথায়, অন্যের কোনো ক্ষতি বা সমস্যা না করে নিজের ইচ্ছায় চলতে পারার নামই হল স্বাধীনতা। স্বাধীনতা শব্দের ঠিক বিপরীত শব্দ হল পরাধীনতা। মানে পরের অধীনে থাকা।
শায়লা বলল, দোয়েল ভাইয়া, তোমার কথা আমি একটু একটু বুঝেছি। কিন্তু ঠিকমতো সব বুঝতে পারছি না।
আচ্ছা ঠিক আছে, বুঝিয়ে বলছি তোমায়। এই যে দেখছ না আমি কেমন স্বাধীন। ইচ্ছে হলে আকাশে উড়ে বেড়াই। ইচ্ছে হলে গাছের ডালে শিস্ দিয়ে গান গাই। ইচ্ছে হলে খাবার খুঁজে বেড়াই, ইচ্ছে হলে ঘুমাই। কেউ আমায় বাধা দিতে পারে না। তার মানে আমি স্বাধীন।
শায়লা জিজ্ঞেস করল, আর পরাধীন মানে কী?
তোমাদের বাড়িতে খাঁচার ভেতর যে পাখি দুটো আছে ওরা হল পরাধীন। ইচ্ছে হলেও ওরা এই বিশাল খোলা আকাশে উড়তে পারে না। তোমরা খেতে দিলে খায় আর না খেতে দিলে না খেয়ে থাকে। নিজের ইচ্ছায় কোনো কিছুই করার শক্তি ওদের নেই। তাই ওরা হল পরাধীন।
শায়লা মনে মনে কী একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, তাহলে তো ওদের ভীষণ কষ্ট।
দোয়েল পাখি বলল, তা তো বটেই। বদ্ধ খাঁচায় থাকতে পাখিদের ভীষণ কষ্ট হয়। পাখিরা মুক্ত আকাশে উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে বেড়াবে। শিস্ দিয়ে মনের সুখে গান গাইবে। তাতেই না ওদের সুখ। কিন্তু কিছু মানুষ নিজেরা আনন্দ পাওয়ার জন্য শুধু শুধুই ওদেরকে কষ্ট দেয়।
শায়লা আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। দৌড়ে গিয়ে খাঁচাটা নিয়ে এল জানালার কাছে। তারপর খাঁচার ছোট্ট দুয়ারটা খুলে ছেড়ে দিল ছোট্ট সুন্দর পাখি দুটোকে। বলল, আজ আমাদের স্বাধীনতার দিনে তোদেরকেও স্বাধীন করে দিলাম।
ছাড়া পেয়ে পাখি দুটি নীল আকাশে ডানা মেলে দিল। উড়তে উড়তে দূরে চলে গেল ওরা। শায়লা একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন