সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

শুক্রবার, ২০ এপ্রিল, ২০১২

চড়ুই পাখির ছানা

দিন ধরে তিতলিদের বাসার জানালা দিয়ে দুটো চড়ুই পাখি ফুড়ুত্ ফুড়ুত্ করে ঘরের ভেতর আসছে আর যাচ্ছে। কেউ তা খেয়াল না করলেও পাখি দুটোর কাণ্ডকারখানা দেখে তিতলি খুব মজা পাচ্ছিলো। বারান্দার খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে পাখি দুটো চলে যাচ্ছে ওদের স্টোররুমের ওপরের যে খালি জায়গাটা, সেখানে। প্রথম প্রথম ওরা খুব ঘন ঘন আসা-যাওয়া করতো। তখন ওদের ছোট্ট ঠোঁটে ধরা থাকতো ছোটো ছোটো খড়কুটো, শুকনো ডালপালা এসব। দিন পরে ওদের আসা-যাওয়া কিছুটা কমে গেলো। তখন বারান্দায় লোকজন না থাকলে প্রায়ই দেখা যেতো একটা চড়ুই পাখি জানালার গ্রিলের ওপর বসে আছে। অন্যটা তখন কোথায় কী করতো তিতলি তা জানে না।
এমন সময় একদিন ছোটোমামা এলো বাসায়। তখন বাসার মধ্যে একটু হুলস্থুল পড়ে গেলো। মামাবাড়ি যাওয়ার আনন্দে তিতলি থইথই করে নাচতে লাগলো। আর দিন গুনতে লাগলো কখন মামাবাড়ি যাওয়ার দিনটা আসবে।
মামাবাড়ি যাওয়ার আনন্দে চড়ুই পাখি দুটোর কথা একদম ভুলে গেলো তিতলি।
একদিন সকালে বাসার সবাই ব্যাগট্যাগ নিয়ে, দরজায় তালাটালা দিয়ে চলে গেলো তিতলির মামাবাড়ি। খুব সকালবেলা নিজেদের মাইক্রোবাসটায় করে রওনা হলো ওরা। দুপুরের আগেই পৌঁছে গেলো মামাবাড়ি। তারপর শুধু মজা আর মজা।
সারাদিন ছোটোমামার সাথে সাথে টইটই করে ঘুরে বেড়ালো তিতলি। ছোটোমামা গাছ থেকে কাঁচা আম পেড়ে খাওয়ালো, ডাব পেড়ে খাওয়ালো। তিতলিরা আসার আগেই মামি নানারকম পিঠা বানাবার আয়োজন করে রেখেছিলেন। তৈরি হলো নানান রকম পিঠা। সারাদিন মহা আনন্দ করে রাতে ঘুমাতে গেলো তিতলি।
সেই রাতেই এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলো তিতলি।
তিতলিদের বাসার সেই চড়ুই পাখি দুটো এলো তিতলির কাছে। ওদের চেহারা দেখেই তিতলি বুঝতে পারলো ওদের মন ভীষণ খারাপ।
কী ব্যাপার! তিতলি চলে আসায় ওদের মন খারাপ হয়েছে বুঝি!
কিন্তু না। পাখি দুটো বলতে লাগলো, তিতলি আপু, বাসার সব দরজা জানালা বন্ধ করে তোমরা সবাই চলে এলে। আর এদিকে আমরা দুজনই আটকা পড়েছি বাইরে। কিন্তু তোমাদের বাসার ভেতরে আমাদের ছানা দুটো আটকা রয়েছে। কাল সারাদিন না খেয়ে রয়েছে ছানা দুটো। অনেক চেষ্টা করেও তোমাদের বাসায় ঢোকার কোনো পথ পাইনি আমরা।
ওদের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো তিতলির।
পরদিন সকালে উঠেই কান্নাকাটি জুড়ে দিলো সে। এখনই তাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে।
বাবা মা মামা মামি সবাই অবাক হয়ে গেলো। যে মেয়ে মামাবাড়ি আসার জন্য পাগল, স্কুলের ছুটি শেষ হয়ে গেলেও যে মেয়ে মামাবাড়ি ছেড়ে যেতে চায় না, সে কিনা মামাবাড়ি থাকতে চাচ্ছে না!
মামা বললেন, কী হয়েছে মামণি? মামি কিছু বলেছে?
না। কাঁদতে কাঁদতে জবাব দেয় তিতলি।
মা জিজ্ঞেস করলেন, কোনো খেলনা টেলনা ফেলে এসেছো বুঝি! কোনো অসুবিধা নেই। কাল তোমার বাবা ঢাকায় যাবে। সে- নিয়ে আসবে তোমার খেলনা।
না, তিতলি কোনো খেলনাও ফেলে আসেনি।
তবে?
অনেক বোঝানো টোঝানোর পর মুখ খুললো তিতলি।
কাল রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে।
তিতলিদের স্টোররুমের ওপরে বাসা বেঁধেছে দুটো চড়ুই পাখি। বাসা বেঁধে ডিম পেড়েছে মেয়ে চড়ুইটা। কদিন আগে সে ডিম ফুটে দুটো বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চাদের জন্য খাবার নিয়ে তিতলিদের বারান্দার জানালাটা দিয়ে ঢুকতো চড়ুই পাখি দুটো। কিন্তু ওরা বাসার সব দরজা জানালা বন্ধ করে চলে আসায় পাখি দুটো বাইরে আটকা পড়েছে। আর বাচ্চা দুটো আটকা পড়েছে বাসার মধ্যে। কাল সারাদিন সারারাত অনেক চেষ্টা করেও চড়ুই পাখি দুটো বাসায় ঢুকতে পারেনি। আর না খেতে পেয়ে ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছে ওরা।
তিতলির কথা শুনে মা বললেন, এই কথা! তুমি নিশ্চয় স্বপ্নে দেখেছো।
তিতলি বললো, হ্যাঁ, আমি স্বপ্নই দেখেছি। তবে স্বপ্নের মধ্যে চড়ুই পাখি দুটো এসে বলে গেছে ওদের কষ্টের কথা।
মামি বললেন, তিতলি মামণি, স্বপ্নের কথা কোনোদিন সত্য হয় না। তুমি হয়তো পাখি দুটোকে অনেক ভালোবাসো, ওদেরকে নিয়ে অনেক চিন্তা করো। তাই এসব স্বপ্ন দেখেছো।
সব কথা শুনে মা বললেন, আসলেই দিন ধরে দুটো চড়ুই পাখিকে সারাদিন বাসার মধ্যে আসা-যাওয়া করতে দেখেছি। হয়তো আমাদের বাসার মধ্যে ঠিকই বাসা বেঁধেছে ওরা। সে বাসায় বাচ্চা থাকলেও থাকতে পারে।
বাবা বললেন, তা পারে। কিন্তু চড়ুই পাখি তো খুব ছোটো পাখি। ওরা ঠিকই একটা পথ বের করে নেবে বাসায় ঢোকার।
মা বললেন, তুমি হয়তো খেয়াল করোনি, আমাদের স্টোররুমের ওপরের জায়গাটায় পাখি দুটো ঢুকতে পারে একমাত্র বারান্দার জানালা দিয়েই। সেই জানালা যখন আমরা বন্ধ করে এসেছি, পাখি দুটো সমস্যায় পড়তেও পারে।
বাবা বললেন, তাই বলে স্বপ্নের মধ্যে তিতলিকে এসে এসব কথা বলবে চড়ুই পাখিরা! এও কি সম্ভব!
কথার কোনো জবাব দিলেন না মা।
বাবা আবার বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, তিতলিকে যখন কোনোভাবেই সামলানো যাচ্ছে না, আমি আজই ঢাকায় যাচ্ছি। দেখি কী অবস্থা।
কিন্তু না, বাবা একা গেলে হবে না, তিতলিকেও নিতে হবে সঙ্গে।
শেষমেশ তিতলিকে নিয়েই ওর বাবা গেলেন ঢাকায়।
ঢাকায় গিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে বাসায় ঢুকতেই তিতলি দৌড়ে চলে গেলো বারান্দার জানালার কাছে। তার পেছন পেছন বাবাও গেলেন। এক মুহূর্ত দেরি না করে জানালার পাল্লাটা খুলে দিলো তিতলি। আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘটলো আজব ঘটনাটা। দুটো চড়ুই পাখি মুখে খাবার নিয়ে ফুড়ুত্ করে ঢুকে পড়লো জানালা দিয়ে। তিতলি আর তার বাবা চেয়ে রইলো পাখি দুটোর দিকে। জানালা দিয়ে ঢুকে চড়ুই পাখি দুটো সোজা উড়ে চলে গেলো স্টোররুমের ওপরের খালি জায়গাটায়। আর সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেলো দুটো বাচ্চা চড়ুই পাখির কিচির মিচির শব্দ।
তিতলির দিকে চেয়ে হেসে ফেললেন বাবা। তিতলিও হাসলো বাবার দিকে চেয়ে।
তিতলি বললো, কী বাবা, স্বপ্ন কি সত্যি হয়?
বাবা বললেন, কখনও কখনও হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন