মাঝরাতের দিকে কিছু একটা
শব্দে ঘুম ভেঙে
গেল রবিনের। সে শুয়ে
ছিল তাদের দোতলার একটা রুমে। রবিনের রুমটা বাড়ির সামনের দিকে। রবিন তার
খাটে শুয়ে শুয়েই
বাড়ির মূল গেট
এবং চারপাশের প্রাচীরের কিছুটা অংশ দেখতে
পায়।
আজ
রাতে সুন্দর জোছনা উঠেছে
বাইরে। কয়েকদিন আগে পূর্ণিমা গেছে। আজ সন্ধ্যারাতে চাঁদ উঠেছে একটু
দেরিতে। কিন্তু মাঝরাতে চাঁদের আলোয় বাইরের সবকিছুই প্রায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো
বাইরেটা দিনের আলোর
মতোই পরিষ্কার। রবিন শুয়ে
শুয়েই তাদের আঙিনায় লাগানো ফুলগাছ, সামনের রাস্তা, রাস্তার ওপারের বাড়ি-সবই
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো।
রবিন
বাইরের দিকে তাকিয়ে এসব দেখছিলো আর কিছু
একটা ভাবছিলো। এমন সময়
তার চোখে পড়লো
তাদের প্রাচীরের এপাশটায় কিছু একটা
নড়াচড়া করছে। একটু
খেয়াল করতেই তার
মনে হলো একটা
মানুষ গুটিসুটি মেরে বসে
রয়েছে সেখানে।
প্রথমে রবিন কিছুটা ভয় পেয়ে
গেলো। কিন্তু পরে চিন্তা করলো, একটা মানুষই তো সে দেখতে
পাচ্ছে। এতে ভয়
পাওয়ার কী আছে?
আর তাছাড়া মানুষটা তো ঘরের
বাইরে। ঘরের মধ্যে
তো আর ঢুকতে
পারছে না! তাই
রবিনের কোনো ক্ষতিও সে করতে পারবে
না। এই ভেবে
রবিন ঠিক করলো,
না, সে ভয়
পাবে না। দেখবে
লোকটা কী করে।
এমন
সময় ছায়ামূর্তিটা আবার নড়েচড়ে উঠলো। এতক্ষণ মনে হচ্ছিলো মানুষটা বসে আছে।
এবার উঠে দাঁড়ালো সে। দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে রবিনদের বাড়ির পেছনদিকটায় চলে গেলো। পেছনদিকে যাওয়ার জন্য রবিন
আর তাকে দেখতে
পাচ্ছিলো না। এখন
কী করা উচিত
রবিনের, ভাবতে লাগলো
মনে মনে। সে
কি তার মা-বাবাকে বলবে যে
একটা চোর এইমাত্র তাদের প্রাচীর ডিঙিয়ে বাড়ির মধ্যে
ঢুকে পড়েছে? নাকি
দারোয়ান চাচাকে ডাকবে?
কিন্তু দারোয়ান চাচাকে ডেকে তো
কোনো লাভ হবে
না। তাকে ডাকার
শব্দ পেলেই চোর
পালিয়ে যাবে। তার
চেয়ে সে নিজেই
দেখবে লোকটা কী
করে।
বিছানা ছেড়ে উঠলো রবিন।
উঠে বাড়ির পেছনদিকের জানালার কাছে চলে
গেলো। গিয়ে আবারও
ছায়ামূর্তিটা দেখতে পেলো
সে। ছায়ামূর্তিটা তখন সেই
জানালা সোজা এগিয়ে
আসছিলো।
রবিনদের বাড়ির তিনদিকেই বারান্দা। শুধু পেছনের দিকটা ছাড়া। তাদের
রান্নাঘরের জানালাটা খুবই ছোটো।
তবে সেটা একেবারেই খোলা। একটা মানুষ
ঢোকার মতো জায়গা
আছে সেখানে। কিন্তু দোতলার জানালায় কীভাবে আসবে চোর
বা অন্য কিছু-
এই চিন্তা করে জানালাটা খোলাই রাখা হয়
দিন রাত সব
সময়।
রবিন
খেয়াল করলো ছায়ামূর্তিটা তাদের রান্নাঘরের সেই জানালা সোজা হেঁটে আসছে।
তারপর একসময় সানসেটের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলো
সেটা।
রবিন
ভাবতে লাগলো কী
করা যায়।
এমন
সময় আবার একটা
ছোট্ট শব্দ হলো
তাদের রান্নাঘরের জানালার ওখানে। শব্দ পেয়ে
রবিন আবারও লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগলো
কী হচ্ছে। একসময় ছায়ামূর্তিটা তার মাথা গলিয়ে
দিলো জানালার ফাঁকে। তারপর টুপ
করে লাফিয়ে পড়ল রান্নাঘরের ভিতরে।
রবিন
ভাবলো এবার হয়তো
চোরটা তাদের বাড়ির
রুমগুলোতে ঘোরাঘুরি শুরু করবে।
টাকাপয়সা সোনাদানা যা যা
পাবে সবই নিয়ে
যাবে। কিন্তু না, চোরটা
রান্নাঘর থেকে বের
হলো না।
রান্নাঘরের আবছা আলোয় রবিন
উঁকি দিয়ে দেখলো
চোরটা রান্নাঘরের হাঁড়িপাতিল নাড়াচাড়া করছে।
একটা
প্লেট হাতে নিলো
চোরটা। তারপর ভাতের
হাঁড়ি থেকে ভাত
আর তরকারির পাতিল থেকে
তরকারি নিয়ে গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করলো।
এমন
সময় রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো
রবিন। ঢুকে বললো,
কী করছ চোর
ভাই?
রবিনকে দেখে ভূত দেখার
মতো চমকে উঠলো
চোর। রবিন বললো,
তোমার ভয় নেই
চোর ভাই। এ
বাড়ির কেউ তোমাকে দেখতে পায়নি। শুধু আমিই
দেখেছি। আমি না
বললে কেউ তোমার
কথা জানতেও পারবে না,
দেখতেও পারবে না।
তুমি নিশ্চিন্তে ভাত খাও।
রবিনের কথা শুনে অবাক
হয়ে গেলো চোর।
সে বললো, গত
তিন দিন ধরে
কিচ্ছু খাইনি। তাই চুরি
করে ভাত খেতে
এসেছি। তুমি বিশ্বাস করো, এই দুমুঠো ভাত ছাড়া আমি
আর কিচ্ছু নেবো না
তোমাদের বাড়ি থেকে।
তুমি কাউকে বোলো
না কিন্তু।
রবিন
বললো, ঠিক আছে
কাউকে কিছু বলবো
না। তবে আমার
কয়েকটি কথার জবাব
দিতে হবে তোমাকে।
চোর
বললো, কী কথা
বলো।
রবিন
বললো, তার আগে
তুমি খাওয়া শেষ
করো।
চোর
খেতে লাগলো। রবিন আস্তে
করে তার পাশে
বসলো।
খাওয়া
শেষ হলে রবিন
জিজ্ঞেস করলো, কেন
চুরি করতে এসেছ?
ধরা পড়লে পিট্টি খেতে হবে জানো
না বুঝি!
চোর
বললো, আগেই তো
বলেছি তিন দিন
ধরে কিছু খাইনি। আজও যদি খেতে
না পেতাম তাহলে
কাল পর্যন্ত হয়তো বেঁচেই থাকতে পারতাম না।
রবিন
বললো, যদি ধরা
পড়ে যেতে তাহলে
কী হতো ভাবতে
পারো?
হ্যাঁ
পারি, প্রচণ্ড মার খেতাম। থানা পুলিশেও দিয়ে দিতে
পারতো। অবশ্য থানায়
দিলে ভালোই হতো।
তিনবেলা খেতে পারতাম। সেটা কোনো চিন্তার ব্যাপার না, চিন্তা হলো বউ আর
ছেলেমেয়ে দুটো নিয়ে।
আজ তিন দিন
হয় ওরাও সবাই
প্রায় উপোস।
তাহলে
এখন কী করবে?
ভেবেছিলাম নিজে কিছুটা ভাত তরকারি খেয়ে বাকিটা ওদের জন্য
নিয়ে যাবো। কিন্তু তা তো আর
হচ্ছে না। তুমি
দেখে ফেলেছো। এখনই হয়তো
বড়দের খবর দেবে।
ধরা পড়ে যাবো
আমি। প্রচণ্ড মার খাবো।
তারপর কী হবে
জানি না।
রবিন
বললো, না, ওসবের
কিছুই হবে না।
এখানে ভাত তরকারি যা কিছু আছে
সব নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও তুমি।
আগে তোমার বাচ্চাদের বাঁচাও। তারপর অন্য
কথা।
রবিনের কথা শুনে চোর
খুব খুশি হলো।
তারপর বললো, তুমি
খুব ভালো ছেলে।
আজ শুধু তোমার
দয়ায় আমার ছেলেমেয়েদের জীবন হয়তো বেঁচে
যাবে। আমি দোয়া
করব তুমি যেন
অনেক অনেক বড়
মানুষ হতে পারো।
রবিন
বললো, তবে একটা
কথা দিতে হবে
আমাকে।
চোর
বললো, কী কথা?
প্রতিদিন এই সময় আমার
রুমের জানালাটার সামনে আসবে
তুমি। কষ্ট করে
তোমাকে আর বাড়ির
ভেতরে ঢুকতে হবে
না। আমিই জানালা দিয়ে তোমাকে খাবার দাবার
দিয়ে দেবো।
চোর
রাজি হলো। তারপর
রবিনের কাছ থেকে
বিদায় নিয়ে চলে
গেলো সে।
পরদিন
রাতে ঠিকই রবিনের জানালার সামনে এসে
হাজির হলো সেই
ছায়ামূর্তিটা। তাকে দেখেই
রান্নাঘর থেকে খাবারদাবার নিয়ে এসে হাজির
হলো রবিন। কিন্তু চোর বললো, না,
খাবারের কোনো দরকার
নেই। কাল দিনে
আমি একটা কাজ
পেয়েছি। সেই কাজটা
করে প্রতিদিন যে পয়সা
পাবো তাতে আমাদের সংসার কোনোমতে চলে যাবে।
আমি এসেছি শুধু
তোমাকে দেওয়া কথা
রাখার জন্য। আর
মন ভরে তোমাকে দোয়া করার জন্য।
চোরের
কথায় রবিন খুবই
খুশি হলো। সে
বললো, ঠিক আছে,
যাও। তবে একটা
কথা মনে রেখো,
আর কোনোদিন চুরি করতে
কোথাও যাবে না
তুমি। যদি আবারও
কোনো সমস্যায় পড়ো তাহলে
সোজা আমার কাছে
চলে আসবে। বাবাকে বলে একটা কাজের
ব্যবস্থা করে দেব।
কিন্তু চুরি করতে
গিয়ে যদি ধরা
পড়ে যাও তাহলে
তোমার বাচ্চারা যে বাড়িতে না খেয়ে মরবে।
যত
বিপদই আসুক আর
কোনোদিন চুরি করবে
না-এমন কথা
দিয়ে রবিনের কাছ থেকে
বিদায় নিয়ে চলে
গেলো চোর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন