দুপুরের এই সময়টায় ঘুমাতে একটুও ভালো
লাগে না তিতলির। তবুও প্রতিদিন দুপুরে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ ঘুমায় ও। বাবা
বলেন, এ সময়টায় ঘুমানো স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
তিতলিদের বাড়িটা দোতলা। আর দোতলার দক্ষিণ দিকের একটা
ছোট্টো রুম তিতলির। সেই রুমের জানালার ধারের খাটটায় দিনের বেলা
একা একা শুয়ে
থাকতে তিতলির একটুও খারাপ
লাগে না। কারণ
ওদের বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটায় আছে এক
বিরাট চালতাগাছ। সেই চালতাগাছে সারা দিন পাখিদের কিচির-মিচির লেগেই
থাকে। দোয়েল, শালিক,
কাক, টুনটুনি, ফিঙে, শ্যামা, বুলবুলি-কতো পাখি
তার হিসেব নেই।
প্রতিদিন দুপুরে তিতলি শুয়ে
শুয়ে এসব পাখি
দেখে। আর তাদের
সঙ্গে মনে মনে
কথা বলতে বলতে
ঘুমিয়ে পড়ে।
আজও
পাখিদের দেখতে দেখতে
চোখ দুটো একসময়
বুজে আসে তিতলির। এমন সময় দোয়েল
পাখিটা এসে জানালার কাছে বসে। তার
সঙ্গে সঙ্গে আরও
আসে শালিক, কাক,
টুনটুনি, ফিঙে, শ্যামা আর বুলবুলি। দোয়েলকে দেখে তিতলি
বলে, কী ব্যাপার দোয়েল ভাইয়া, মন
খারাপ নাকি?
দোয়েল
বলে, হ্যাঁ তিতলি
আপু, আমরা আজ
তোমাকে ছেড়ে চলে
যাচ্ছি তো, তাই
মনটা ভীষণ খারাপ।
তিতলি
বলে, কেনো কেনো,
তোমরা আমাকে ছেড়ে
চলে যাচ্ছো কেনো? তাহলে
আমি একা একা
থাকবো কেমন করে?
শালিক
পাখিটা বলে, আমরা
তো যেতে চাইনি। কতোদিন ধরে থাকছি
তোমাদের এই চালতাগাছটায়। আর এখানে বসে
রোজ রোজ তোমাকে দেখে দেখে তোমার
সঙ্গে ভাব হয়ে
গেছে না আমাদের! কিন্তু কী করবো
বলো? ওই যে
দেখো, কতোগুলো লোক ইয়া
বড়ো এক করাত
নিয়ে এসেছে গাছটা
কাটার জন্য। চালতা
গাছটা কেটে ফেললে
আমরা থাকবো কোথায়,
বলো? আমরা যে
গাছপালা ছাড়া থাকতে
পারি না।
এমন
সময় কী একটা
ঘড়ঘড় শব্দে তিতলির ঘুম যায় ভেঙে।
চোখ খুলে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ও দেখে,
কতোগুলো লোক লম্বা
একটা করাত দিয়ে
চালতাগাছটার গোড়া কেটে
ফেলছে। গাছের ঘন
পাতার মধ্যে পাখিগুলো সব অস্থির হয়ে কিচির-মিচির করছে
আর ওড়াউড়ি করছে।
পরদিন
দুপুরবেলা একইভাবে শুয়ে ছিলো
তিতলি। আজ ওর
মন ভীষণ খারাপ। বিশাল চালতাগাছটার জায়গাটা ফাঁকা পড়ে
রয়েছে। পাখিগুলো নেই। অনেকক্ষণ ধরে খালি জায়গাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
তার চোখে পানি
এসে যায়। একসময়
চোখ বুজে আসে
তিতলির।
এমন
সময় আশ্চর্য রকম সুন্দর দুটি পাখি এসে
প্রথমে তার জানালায় বসে। কিন্তু কী আশ্চর্য, জানালা দিয়ে ঢুকে
পাখি দুটি সোজা
তিতলির খাটের ওপর
এসে বসে। আর
বসেই দুটি সুন্দর মেয়ে হয়ে যায়
তারা। মেয়ে দুটি
তিতলির দুপাশে বসে। ডানদিকের মেয়েটি বলে, আমি
লাল পরি আর
ও নীল পরি।
আর তুমি তিতলি,
তোমাকে তো আমরা
আগে থেকেই চিনি।
তিতলি
এই প্রথম খেয়াল
করে যে ওরা
দুজন মানুষের মতো দেখতে
হলেও ওদের দুটি
করে ডানা আছে।
নীল
পরি বলল, আমরা
জানি আজ তোমার
মন ভালো নেই।
তাইতো আমরা তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। আমাদের সঙ্গে পরির
রাজ্যে চলো, দেখবে
তোমার মন ভালো
হয়ে যাবে।
তিতলি
বলে, তোমাদের রাজ্য, মানে
পরিদের দেশ! সে
তো আমি গল্পে
পড়েছি। সেখানে আবার যাওয়া
যায় নাকি? কোথায়
তোমাদের দেশ?
সে
অনেক অনেক দূরে।
কোনো মানুষ সেখানে যেতে পারে না।
তবে আমরা যদি
কাউকে নিয়ে যাই,
সে যেতে পারে।
নীল পরি বলে।
আচ্ছা,
তোমাদের না হয়
ডানা আছে, উড়ে
উড়ে যেতে পারবে। কিন্তু আমি কীভাবে যাবো তোমাদের দেশে? তিতলি
জিজ্ঞেস করে।
তুমি
আমাদের পিঠের ওপর
বসবে, আমরা উড়িয়ে
নিয়ে যাবো তোমাকে। হ্যাঁ, আর দেরি
নয়, আম্মু টের
পেয়ে গেলে কিন্তু আর যাওয়া হবে
না।
আচ্ছা,
চলো তাহলে।
তিতলিকে নিয়ে উড়ে চললো
লাল পরি আর
নীল পরি। উড়তে
উড়তে মেঘেদের রাজ্য ছাড়িয়ে, তারাদের রাজ্য পেরিয়ে একসময় পরিদের রাজ্যে পৌঁছলো ওরা।
পরিদের রাজ্যে পৌঁছে তো
অবাক তিতলি। এতো সুন্দর কোনো দেশ থাকতে
পারে! এতো গাছ,
এতো ফুল, এতো
পাখি তিতলি জীবনেও দেখেনি। আনন্দে নাচতে ইচ্ছে
হয় তিতলির। তিতলির মনের কথা
বুঝতে পেরে লাল
পরি বলে, কী,
বললাম না, আমাদের দেশে গেলে তোমার
মন ভালো হয়ে
যাবে! এখানে তুমি
মনের আনন্দে ঘুরতে পারো।
পাখিদের সঙ্গে, ফুলদের সঙ্গে কথা বলতে
পারো। দেখবে তোমার
মন ভালো হয়ে
গেছে।
একটু
দূরে তাকাতেই তিতলি দেখতে
পায় একটা নদী।
হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে
যায় ও। নদীর
পানিতে একটুও ঢেউ
নেই। নদীর পানি
এতো স্বচ্ছ আর নীল
হতে পারে তা
কোনোদিন ভাবতেও পারেনি ও। সে
পানিতে লাল, নীল,
হলুদ কতো রঙের,
কতো বর্ণের মাছ যে
ভেসে বেড়াচ্ছে তার হিসেব
নেই। তিতলি বলে,
বাহ, খুব সুন্দর তো তোমাদের দেশ! আচ্ছা,
আমাদের পৃথিবী এ রকম
সুন্দর হতে পারে
না?
লাল
পরি বলে, তোমাদের পৃথিবীও আগে এ
রকমই ছিলো। কিন্তু কিছু লোভী মানুষ
গাছ কেটে কেটে,
মাছ মেরে মেরে
আজ এ অবস্থা করেছে সুন্দর পৃথিবীর। গাছ কাটার
জন্য পাখিদের থাকার জায়গা
নেই। তাই সব
পাখি এখন এখানে
চলে এসেছে। তোমাদের নদীর পানিতে ময়লা ফেলে এমন
অবস্থা করেছে যে
সেখানে মাছদের থাকার অবস্থা নেই। আর যাও
ছিলো তাও তোমাদের মধ্যে কিছু মানুষ
ডিমওয়ালা মাছ, পোনা
মাছ মেরে শেষ
করে দিচ্ছে। তাই তো
তোমাদের নদীর পানি
আজ নষ্ট হয়ে
গেছে। সেখানে কোনো মাছ
নেই।
কিন্তু সেই সুন্দর পৃথিবী আমরা আবার
ফিরে পেতে পারি
না? তিতলি জিজ্ঞেস করে।
হ্যাঁ,
ফিরে পেতে পারো।
তোমাদের পৃথিবী আবার আমাদের এই পরির রাজ্যের মতো সুন্দর হতে পারে।
তবে সেজন্য তোমাদের কিছু কষ্ট
করতে হবে। গাছে
গাছে ভরিয়ে তুলতে
হবে তোমাদের পৃথিবীকে, যেনো পাখিদের থাকার জায়গার অভাব না
হয়। আর পাখি
শিকার করা একদম
চলবে না। নদী
পুকুর খালের পানিকে পরিষ্কার রাখতে হবে।
আর ছোট মাছ,
ডিমওয়ালা মাছ মারা
বন্ধ করতে হবে।
তাহলেই দেখবে তোমাদের পৃথিবীও আবার সুন্দর হয়ে উঠবে।
পরিদের রাজ্যে ঘুরতে ঘুরতে
ছোট্ট একটা পাখির
দিকে চোখ পড়ে
তিতলির। আরে, এ
যে দেখছি সেই
চালত গাছের দোয়েল
পাখিটা! এতোক্ষণে খেয়াল হয়
ওর, দোয়েল পাখিটাও কী যেনো বলতে
যাচ্ছে তিতলিকে।
এই
যে দোয়েল ভাইয়া,
তুমিও এখানে এসে
পড়েছো! আর আমাদের চালতাগাছটার সেই শ্যামা, ফিঙে, শালিক, বুলবুলি-ওরা কোথায়? ওরাও
কি এসেছে নাকি
এখানে?
হ্যাঁ,
ওরাও এসেছে এখানে। কিন্তু সত্যি কথা
কী জানো তিতলি
আপু, এখানে এতো
এতো গাছপালা থাকতেও আমাদের কিন্তু একটুও ভালো
লাগছিলো না। তুমি
নেই তো এখানে
তাই। বলে দোয়েল
পাখিটা।
তাহলে
চলো, আমরা সবাই
আবার সেখানে ফিরে যাই।
তিতলি বলে।
দোয়েল
বলে, তাহলে আমাদের থাকার জন্য, বাসা
বানাবার জন্য একটা
গাছ লাগিয়ে দাও তিতলি
আপু, আমরা সবাই
আবার আগের মতো
আনন্দে থাকবো সেখানে।
ঠিক
আছে, আমি তোমাদের জন্য অনেকগুলো গাছ লাগিয়ে দেবো। তখন কিন্তু তোমরা ফিরে আসবে।
এমন
সময় আম্মু এসে
তিতলিকে ডাকতে থাকেন,
এই তিতলি, ওঠো
ওঠো। কাল না
তোমার জন্মদিন। মার্কেটে যেতে হবে।
নতুন জামাকাপড় কিনতে হবে
তোমার জন্য।
না
আম্মু, জন্মাদিনে আমার জামার
দরকার নেই। আমাকে
অনেকগুলো গাছের চারা
কিনে দেবে। সেগুলো বড়ো হলে দোয়েল,
শ্যামা, ফিঙে, বুলবুলি আরও কতো পাখি
বসবে সেখানে! জন্মদিনের কেক কাটার
চেয়ে ওদের সঙ্গে
কথা বলতে আমার
ভীষণ ভালো লাগবে। তিতলি বলে।
ঠিক
আছে, জন্মদিনে অনেকগুলো গাছের চারাও
উপহার দেবো তোমাকে।
তিতলির চোখে তখন পরিদের দেশের ছবি ভেসে
ওঠে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন