সকাল থেকেই লোকজন
কীসব বলাবলি করছে তার
কিছুই বুঝতে পারছে
না রমিজ। আবহাওয়ার দশ নম্বর সিগন্যাল নাকি দেওয়া হয়েছে
ওদের এলাকায়। সবাইকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। পিঠে লাল চাঁদের মতো আঁকা রেডক্রিসেন্ট না কীসের লোকজনও ছোট্টো মাইকে এসব
কথা ঘোষণা করছে।
কিন্তু ছোট্টো রমিজ কী
করবে বুঝতে পারছে
না কিছুই।
রমিজের মা-বাবা
গতকাল গেছে ওদের
নানাবাড়ি। এখন বাড়িতে ওরা মাত্র দুজন।
এগারো-বারো বছরের
রমিজ আর ওর
সাত-আট বছরের
ছোটো বোন রানু।
আজ সকাল থেকেই
বৃষ্টি হচ্ছে আর
সন্ধ্যায় শুরু হয়েছে
প্রবল বাতাস।
বলেশ্বর নদের বেড়িবাঁধের ওপর বিশাল সড়ক।
সে সড়ক চলে
গেছে দশ-বারো
কিলোমিটার দূরে উপজেলা শহর মঠবাড়িয়ায়। এই সড়কের
পাশে নদীর পারে
ছোট্টো ছোট্টো ঝুপড়ি ঘর
বানিয়ে থাকে রমিজদের মতো আরও বিশ-পঁচিশ ঘর
পরিবার। রমিজদের ঝুপড়ি ঘরের
ফুটো চাল দিয়ে
পানি পড়তে পড়তে
মাটির মেঝে কাদায়
জবজব করছে। তারই
এককোণে প্রায় সারাদিনই ছোটো বোনটিকে নিয়ে জড়াজড়ি করে বসে আছে
রমিজ। মা-বাবা
ফিরে আসার কথা
থাকলেও বৃষ্টির জন্য হয়তো
আসতে পারেনি।
বিকালের দিকে কয়েকটি ঝুপড়ির কিছু লোক
চলে গেছে সাইক্লোন শেল্টার না কোথায়
যেনো। রমিজকেও তারা বলছিলো সঙ্গে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কী করে যাবে
ওরা? বৃষ্টি আর বাতাসের তোড় সইতে না
পেরে ওদের ছোট্টো গাইগরুটা ঘরেরই এককোণে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ম্যা ম্যা
করছে কদিন আগে
বিয়ানো ছাগলটা। হাঁস-মুরগিগুলো অবশ্য সকাল থেকে
খোপ ছেড়ে বাইরেই বেরোয়নি। খোপের ওপরটা
কদিন আগে গোলপাতা দিয়ে ছেয়ে দেওয়ায় সেটিতে হয়তো বৃষ্টির পানি পড়ছে না।
দুপুরের দিকে হাঁড়িতে থাকা পান্তাভাতগুলো খোপের মধ্যে
ছড়িয়ে দিয়েছে রমিজ। গরুটাকেও কিছু ভেজা খড়
জুগিয়ে দেওয়া হযেছে
ঘরের মধ্যেই। এতোসব কাজ
ফেলে রমিজ কিছুতেই সাইক্লোন শেল্টারে যাওয়ার উপায় খুঁজে
পেলো না। তার
ওপর পাশের ঘরের
কুদ্দুস কাকা দুপুরে বললো, অরা যতো
চিল্লাচিল্লিই করুক না
ক্যান, দেহিস, শ্যাষ
পর্যন্ত কিছুই অইবে
না। মনে নাই,
কয়দিন আগেও তো
অরা কইছেলে সুনামি না কী
যেনো আইতেছে। সবাই ঘর
ছাইড়া বড়ো রাস্তায় গিয়া উঠছিলাম। কই, আইছেলে কিছু?
কিছুই হবে না,
এই আশায় রমিজও
বসে আছে সকাল
থেকে। কিন্তু সন্ধ্যার পর কিছুটা ভয় ভয় হতে
লাগলো তারও। বাতাস
আর বৃষ্টি বাড়তে বাড়তে
ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে এখন। ওদের গরু-ছাগল দুটো
ছাড়াও আশপাশের ঘরগুলো থেকে হাম্বা হাম্বা আর ম্যা
ম্যা শব্দের চিত্কার চেঁচামেচি বেড়েইে চললো। হঠাত্
রমিজদের ঘরের কাছাকাছি বড়ো রাস্তার পাশের একটা
বড়ো চাম্বল না মেহগনি গাছ কড়কড় শব্দে
ভেঙে পড়লো। সাথে
সাথে আরও একটা
গাছ ভেঙে পড়ার
শব্দ শোনা গেলো।
এরপর আরও একটা।
তারপর আরও, আরও
এবং আরও। রমিজের মনে হলো পৃথিবীর সব গাছপালাই হয়তো এই
মুহূর্তে ভেঙে পড়ছে।
ভাঙা গাছের ছোটো
ছোটো ডাল, বড়ো
বড়ো ডাল শোঁ
শোঁ আর মড়মড়
শব্দে উড়ে যাচ্ছে বাতাসের সঙ্গে। সেসব শব্দের সঙ্গে আশপাশের ঘরগুলো থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসতে
লাগলো। এতোসব শব্দে
ভয় পেয়ে বারবার রমিজকে জড়িয়ে ধরছিলো ছোট্ট রানু। তার
ওপর দূরে নদীর
মধ্যে আগুনের ফুলকি দেখে
রমিজকে আরও জোরে
জড়িয়ে ধরলো সে।
এ অবস্থায় কী করবে
ভাবতে লাগলো রমিজ।
এমন সময় বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দের সঙ্গে ফোঁস ফোঁস
ধ্বনির আরেকটা ভয়ঙ্কর শব্দ যোগ
হলো।
বাতাসের প্রচণ্ড একটা ধাক্কায় রমিজদের ঘরের আধভাঙা দরজাটা আগেই উড়ে
গিয়েছিলো। সেই খোলা
দরজা দিয়ে বাইরে
চোখ পড়তেই আরও
আঁতকে উঠলো রমিজ।
ওদের ঘরের দরজা
পর্যন্ত এসে পড়েছে
বলেশ্বর নদের পানি।
চোখের পলকে পলকে
আরও বাড়তে লাগলো
সেই পানি। রমিজের পায়ের গোড়ালি, হাঁটু, কোমর
ডিঙিয়ে পানি বাড়তে
লাগলো আরও, আরও,
আরও। রমিজ বুঝলো
বেঁচে থাকতে হলে
কিছু একটা তাকে
করতেই হবে।
এবার সাহসে ভর
দিয়ে শক্ত হয়ে
দাঁড়ালো সে। ছোটো
বোনটিকেও সাহস যোগাতে লাগলো। রানুকে বললো পেছন
থেকে শক্ত করে
তার গলা জড়িয়ে
ধরার জন্য। বেঁচে
থাকলে দুজনই বাঁচবে আর মরতে হলেও
দুই ভাইবোন একসঙ্গেই মরবে। এ
সময় আর একটা
দমকা হাওয়া এসে
ওদের ঘরের চালটা
উড়িয়ে নিয়ে গেলো।
গরু-ছাগল আর
হাঁস-মুরগির কথা অনেক
আগেই ভুলে গিয়েছিলো ওরা। রমিজ ভাবলো,
ঘরের চালটা উড়ে
গিয়ে ভালোই হয়েছে,
আর একটু পানি
বাড়লে ওদের বের
হওয়ার দরজাও বন্ধ
হয়ে যেতো। এখন
মাথার ওপর চাল
না থাকায় বের
হওয়ার একটা রাস্তা পাওয়া গেলো।
বুক পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বাতাসের তোড়টা ওরা
এখন আর টের
পাচ্ছিলো না। তবে
পানির তোড় বেড়ে
গেছে অনেক। পানির
তোড় সামলাতে ঘরের একটা
খুঁটি শক্ত করে
ধরে রেখেছিলো রমিজ। কিন্তু তার ছোট হাতে
এতো শক্তি কি
আছে সে তোড়ের
সঙ্গে টিকে থাকার!
এমন সময় রমিজ
দেখলো আস্ত একটা
কলাগাছ পানির সঙ্গে
ভেসে আসছে তাদের
দিকে। কলাগাছটি দেখে তার
সাহস একটু হলেও
বেড়ে গেলো। ঘরের
খুঁটি ছেড়ে কলাগাছটিকে জড়িয়ে ধরলো সে।
রানুকে বললো আরও
শক্ত করে তাকে
ধরে রাখতে। এবার কলাগাছ নিয়ে বড়ো রাস্তার দিকে ভেসে যেতে
লাগলো দুই ভাইবোন। ভাসতে ভাসতে সামনে
বড়ো একটা গাছের
কাণ্ড দেখতে পেলো
ওরা। ছোটো ডালপালা সব ভেঙে উড়ে
যাওয়ার পরও দাঁড়িয়ে থাকা কাণ্ডটাকে দেখতে পেয়ে
এতো বিপদের মধ্যেও আনন্দে চকচক করে
উঠলো ওর ছোটো
চোখজোড়া। বড়ো গাছটিকে ধরতে পারলেই এ যাত্রা হয়তো বেঁচে যাবে
ওরা।
হঠাত্ কলাগাছটিকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে দূরে
সরিয়ে দিয়ে বড়ো
গাছটিকে জড়িয়ে ধরলো
রমিজ। তার মাথার
ওপর দিয়ে বয়ে
যেতে লাগলো বড়ো
বড়ো ঢেউ। কিন্তু কিছুতেই গাছটাকে ছাড়লো না
সে। ঢেউ চলে
গেলে নিশ্বাস নিয়ে পরের
ঢেউয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো রমিজ।
আবার এলো ঢেউ,
আবার চলে গেলো।
আবার নিশ্বাস নিলো সে।
এভাবে একমিনিট, দুমিনিটি, তিনমিনিট করে করে
দশমিনিট পেরিয়ে গেলো নাকি
দশবছর তা ঠাহর
করতে পারলো না
সে।
একসময় কমতে শুরু
করলো পানি। যেভাবে তাড়াতাড়ি বেড়েছিলো পানি, সেভাবেই আবার নেমে গেলো।
জেগে উঠলো বড়ো
রাস্তা, ধানক্ষেত, ভাঙা গাছপালার কাণ্ড, দুমড়ে যাওয়া
মসজিদের ভাঙা ইট,
নদী থেকে ভেসে
এসে রাস্তার ওপর আটকে
যাওয়া ছোটো-বড়ো
নৌকা, বড়ো একটি
লঞ্চ, রাস্তার ওপর আটকে
যাওয়া লঞ্চস্টেশনের পন্টুন, ধ্বংস হওয়া
ঘরবাড়ির খুঁটি-কড়ি-বরগা। পাশাপাশি পড়ে রইলো মানুষ,
গরু, ছাগল, হাঁস,
মুরগি আর গাংচিলের মৃতদেহ। রমিজ এসবের
কিছুই খেয়াল করলো
না। গাছ থেকে
নেমে ছোটো বোনটিকে নামিয়ে দিলো পিঠ
থেকে। ছোটো বোনকে
বাঁচানোর দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে
পেরেছে চিন্তা করে স্বস্তির একটা নিশ্বাস ছাড়লো। তারপর ওয়াপদার বেড়িবাঁধের ওপরে চিত্
হয়ে শুয়ে পড়লো
সে।
[এই গল্পটির বেশিরভাগ অংশই সত্য
ঘটনা অবলম্বনে লেখা। স্থান,
কাল, পাত্র-সবই।
এমনকি রমিজ এবং
রমিজের বয়সও। গল্প
বানানোর জন্য বর্ণনায় কিছুটা সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে
মাত্র।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন