এক
বনের ধারে বাস
করত এক কাঠুরে। তারা ছিল খুব
গরিব। তাদের কোনো
ছেলেমেয়ে ছিল না।
তাই বুড়ো বয়সেও
কাঠুরে কষ্ট করে
বনে যেত কাঠ
কাটতে। না হলে
খাবে কী?
এক
সকালে কাঠুরে প্রতিদিনকার মতো কুড়াল
নিয়ে বনে গেল
কাঠ কাটতে। আর কাঠুরেবউ গেল বাড়ির কাছের
নদীর ঘাটে থালাবাসন ধুতে। এমন সময়
কাঠুরেবউ নদীর পানিতে একটি ফল ভেসে
যেতে দেখল। সে
পানি থেকে ফলটি
তুলল। ফলটি ছিল
গাছ থেকে পড়া
টসটসে পাকা একটি
ডালিম। কাঠুরেবউ ভাবল, নিশ্চয় ডালিমটি খুব মজাদার হবে। কাঠুরেবউ ডালিমটি বাড়িতে নিয়ে গেল।
আর মনে মনে
ভাবল, ফলটি এখন
খাবে না। কাঠুরে ফিরে এলে দুজনে
একসঙ্গে খাবে। এতে
কাঠুরেও নিশ্চয় খুব খুশি
হবে।
কাঠুরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলে
কাঠুরেবউ ডালিম ফলটি
কাটতে গেল। কিন্তু তার হাত ফসকে
ফলটি মাটিতে পড়ে দুভাগ
হয়ে গেল। ভেতর
থেকে বেরিয়ে এল একটি
ফুটফুটে শিশু।
কাঠুরে আর কাঠুরেবউর কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না। তাই
শিশুটিকে পেয়ে তারা
খুব খুশি হল।
আদর-যত্ন করে
তাকে নিজেদের সন্তানের মতো বড়
করে তুলতে লাগল।
আদর করে তার
নাম রাখল ডালিম
কুমার।
ডালিম
কুমার একসময় যুবক
হল। তার যেমন
ছিল সাহস, তেমনি
ছিল হিম্মত। একদিন হঠাত্
সে তার কাঠুরে বাবা-মাকে বলল,
আমি রাক্ষসদের রাজ্যে যাব। তাদের
অনেক দামি দামি
মণি মুক্তা হিরা জহরত
আছে। তাদেরকে মেরে সেগুলো নিয়ে আসব আমি।
আমরা আর গরিব
থাকতে চাই না।
এ
কথায় কাঠুরে আর কাঠুরেবউ ভীষণ ভয় পেল।
ডালিম কুমার তাদের
খুবই আদরের ধন।
রাক্ষসদের রাজ্য থেকে
কেউ কখখনও জীবিত
ফেরেনি। সন্তান হারানোর ভয়ে তারা
ডালিম কুমারকে ওই কাজ
করতে নিষেধ করল।
তারা ডালিম কুমারকে বলল, রাক্ষসরা খুবই ভয়ঙ্কর। কোনো মানুষ তাদের
রাজ্যে গিয়ে আর
ফিরে আসে না।
মানুষেরা শক্তি দিয়ে
রাক্ষসদের হারাতে পারে না।
রাক্ষসেরা মানুষকে আস্ত গিলে
খায়।
কিন্তু ডালিম কুমারের জেদ কিছুতেই কমে না। সে
কোনো কিছু বুঝতে
চাইল না। শেষে
উপায় না পেয়ে
কাঠুরে আর কাঠুরেবউ কাঁদতে কাঁদতে তাকে বিদায়
দিল। কাঠুরেবউ বেশ কিছু
পিঠা বানিয়ে পুঁটলিতে বেঁধে ডালিম
কুমারের কাঁধে ঝুলিয়ে দিল। বলল, বাছা,
যেখানেই থাকো ভালো
থেকো। আর ক্ষুধা লাগলে এই পিঠা
খেও।
পিঠার
পুঁটলি সঙ্গে নিয়ে
ডালিম কুমার রাক্ষসদের রাজ্যের দিকে রওনা
দিল। হাঁটতে হাঁটতে যখন খিদে
পায়, সে একটা
করে পিঠা খায়।
কিছুদূর যাওয়ার পরে একটি
বানরের সঙ্গে তার
দেখা হল। বানরটি বলল, কোথায় চললে
ক্ষুদে ডালিম কুমার?
ডালিম
কুমার বলল, আমি
যাচ্ছি রাক্ষসদের রাজ্যে। ওদের অনেক
ধন সম্পদ। আমি সেসব
ধন সম্পদ আনতে
যাচ্ছি।
বানর
বলল, তোমার পুুঁটলিতে কী?
ডালিম
কুমার বলল, পিঠা।
মা বানিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন খিদে লাগলে
খেতে।
বানর
বলল, আমার কিন্তু খুব খিদে লেগেছে। আমাকে যদি একটা
পিঠা দাও তাহলে
আমিও তোমার সঙ্গ
যেতে পারি।
ডালিম
কুমার বানরকে একটা পিঠা
খেতে দিল। পিঠা
খেয়ে বানর খুবই
খুশি হল। ডালিম
কুমারের পেছন পেছন
চলতে লাগল সে।
আরও
কিছুদূর যাওয়ার পর এক
সুন্দর রঙিন পাখির
সঙ্গে দেখা হল
ডালিম কুমারের। রঙিন পাখি
তাকে জিজ্ঞেস করল, পিউ
পিউ পিউ, কোথায়
যাচ্ছ ডালিম কুমার?
আগের
মতোই উত্তর দিল
সে। রঙিন পাখিও
তার কাছে কিছু
খাবার চাইল। ডালিম
কুমার পাখিকেও একটা পিঠা
দিল। পিঠা খেয়ে
রঙিন পাখি তার
সঙ্গী হল।
বানর
আর রঙিন পাখিকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে
চলল ডালিম কুমার। এমন সময় একটি
কুকুরের সঙ্গে তাদের
দেখা হল। কুকুর
বলল, ঘেউ ঘেউ
ঘেউ, কোথায় যাচ্ছ
ডালিম কুমার?
আমি
যাচ্ছি রাক্ষসদের রাজ্যে। তাদের অনেক
ধন সম্পদ। আমি সেই
ধন সম্পদ নিয়ে
আসব। আমরা আর
গরিব থাকতে চাই
না।
কুকুর
বলল, আমিও যাব
তোমার সঙ্গে। আমাকে সঙ্গে
নিলে তোমার অনেক
সুবিধা হবে। আমি
তোমার অনেক কাজে
লাগব।
ঠিক
আছে, চলো। বলল
ডালিম কুমার।
কুকুর
আবার বলল, ঘেউ
ঘেউ ঘেউ, কিন্তু আমার যে খুব
খিদে পেয়েছে। কিছু না
খেলে আমি যে
হাঁটতেই পারব না।
ডালিম
কুমার কুকুরটিকে একটা পিঠা
দিল। পিঠা খেয়ে
খুশিমনে কুকুরটি লেজ নাড়তে
নাড়তে তার সঙ্গে
চলল।
ডালিম
কুমার এগিয়ে যাচ্ছে রাক্ষসদের রাজ্যের দিকে। তার
পেছন পেছন চলছে
বানর আর কুকুর। আর মাথার ওপর
উড়ে চলেছে ছোট্ট
রঙিন পাখি।
একসময়
তারা রাক্ষস-রাজার প্রাসাদের সামনে গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু প্রাসাদের বিশাল সিংহদরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
সেই দরজা খোলা
যেমন-তেমন কাজ
না। দশটা শক্তিশালী পালোয়ানও পারবে না
দরজা খুলতে। কিন্তু দরজা খুলতে
না পারলে ডালিম
কুমারের এত কষ্ট
করে এতদূর আসাই
যে বৃথা!
এমন
সময় পাখি বলল,
চিন্তা করো না
বন্ধু। আমি উড়ে
ওপাশে গিয়ে দরজা
খুলে দিচ্ছি।
রঙিন
পাখি সত্যি সত্যি
উড়ে দেয়ালের ওপাশে চলে
গেল। গিয়ে বিশাল
সিংহদরজা খুলে দিল।
রাক্ষসদের সৈন্যরা তাদেরকে দেখে তরবারি হাতে তেড়ে এল।
কিন্তু বানর দেয়ালের ওপরে আগে থেকেই
প্রস্তুত ছিল। সে
রাক্ষসদের দিকে একের
পর এক পাথর
ছুড়ে মারতে লাগল।
আর কুকুর খুব
জোরে জোরে ঘেউ
ঘেউ করতে লাগল।
রাক্ষস সৈন্যরা ভয়ে সামনে
এগুবার সাহস পেল
না। সুযোগ পেয়ে
তরবারি উঁচিয়ে বীরের মতো
এগিয়ে চলল ডালিম
কুমার। তাই দেখে
রাক্ষস-রাজা ভয়ে
থরথর করতে লাগল।
সে যুদ্ধ করতে
চাইল না। সৈন্যদের বলল প্রাসাদের ওপর সাদা
পতাকা ওড়াতে।
সাদা
পতাকা দেখে ডালিম
কুমার বুঝল, রাক্ষসরা যুদ্ধ করতে চায়
না। তারা সন্ধি
করতে চায়। সে
রাক্ষস-রাজাকে বলল, ঠিক
আছে, আগে তোমার
সৈন্যরা তাদের তরবারি মাটিতে ফেলে দিক।
রাক্ষস-রাজা সৈন্যদের যার যার
তরবারি মাটিতে ফেলে দিতে
হুকুম দিল। সৈন্যরা তাই করল। এরপর
রাক্ষস-রাজা হাতজোড় করে এসে দাঁড়াল ডালিম কুমারের সামনে। বলল, তুমি
হলে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। তোমার
মতো বীর আমি
জীবনে দেখিনি। আজ থেকে
আমি তোমার গোলাম
হয়ে গেলাম। দয়া করে
আমাদের প্রাণে মেরো না।
এখন থেকে তুমি
যা হুকুম করবে,
আমরা তা-ই
করব।
ডালিম
কুমার বলল, ঠিক
আছে। এখন আমার
কথা মন দিয়ে
শোনো। তোমাদের রাজ্যে অনেক ধন
সম্পদ আছে। আমরা
তোমাদের যুদ্ধে হারিয়ে সেই ধন
সম্পদ নিতে এসেছিলাম। কিন্তু আমরা লোভী
নই। তোমাদের সব ধন
সম্পদ আমরা নেব
না। সামান্য কিছু হলেই
আমাদের চলবে। এতে
তোমরা বাধা না
দিলে আমরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করব
না।
ডালিম
কুমারের উদারতা দেখে রাক্ষস-রাজা অবাক হল।
সে বলল, তোমার
ব্যবহারে আমি খুশি
হয়েছি। তুমি যত
খুশি হিরা মণি
মুক্তা নাও। তোমরা
সেগুলো বয়ে নিতে
না পারলে আমার
সৈন্যরা তোমার বাড়ি
পর্যন্ত দিয়ে আসবে।
ডালিম
কুমার বেছে বেছে
দামি দামি হিরা
মণি মুক্তা থলেতে ভরল।
পঞ্চাশজন রাক্ষস সেই থলেগুলো ডালিম কুমারদের বাড়িতে নিয়ে গেল।
আর পঞ্চাশজন রাক্ষস ডালিম কুমার
আর তার বন্ধুদের নিয়ে গেল রাক্ষস-রাজার পাল্কিতে করে।
ডালিম
কুমারকে ফিরে পেয়ে
কাঠুরে আর কাঠুরেবউয়ের আনন্দ আর ধরে
না। তার ওপর
সঙ্গে আনা অগাধ
ধন সম্পদ দেখে
তারা তো অবাক।
সেই
থেকে গরিব কাঠুরে আর গরিব থাকল
না। তাকে আর
বুড়ো বয়সে কাঠ
কাটতে বনে যেতে
হত না। সুখে
শান্তিতে দিন কাটতে
লাগল তাদের। কুকুর, বানর
আর রঙিন পাখিও
থেকে গেল তাদের
সঙ্গে।
[বিদেশি গল্প অবলম্বনে। ইউপিএল-প্রকাশিত ‘দুষ্টু খরগোস কাহালু’ গ্রন্থ থেকে]