বাবার
নির্দেশ, দৈনিক পত্রিকা পড়ো বা না
পড়ো, প্রতিদিন অন্তত পৃষ্ঠাগুলো উল্টাবে। শাওন তাই
প্রতিদিন বিকেলে তাদের বাসার
দৈনিক পত্রিকাটা উল্টেপাল্টে দেখে। প্রথম
পাতার খবরগুলোর প্রতি তার
তেমন কোনো আগ্রহ
নেই। সে শুধু
ছোটদের পাতা, তথ্যপ্রযুক্তি, খেলাধুলার
খবর এসব পড়ে।
কিন্তু আজ ঘটল
উল্টোটা। প্রথম পাতায়
একটা খবরের শিরোনামে তার চোখ আটকে
গেল। ‘মানিকনগরে মানুষখেকো পুকুর’।
এ পর্যন্ত শাওন মানুষখেকো বাঘ, মানুষখেকো গাছ কিংবা
মানুষখেকো মাছের কথা
জেনেছে, কিন্তু পুকুর যে
কী করে মানুষখেকো হয় তা তার
ধারণার বাইরে। শাওন একমনে
খবরটি পড়তে লাগল।
‘স্টাফ রিপোর্টার : ঢাকার মানিকনগর এলাকার একটি পুকুর
প্রতিবছর একজন করে
মানুষ নিয়ে যায়
বলে সেখানকার লোকজন জানিয়েছে। সর্বশেষ গতকাল মাহি
নামের একটি ছেলেকে নিয়ে গেছে পুকুরটি। এলাকাবাসী জানায়, মাহি
ও রাফি নামের
দুই বন্ধু গতকাল
দুপুরে পুকুরটিতে গোসল করতে
যায়। তারা দুজন
একসঙ্গে ডুব দিলেও
পানির নিচ থেকে
কে একজন মানুষের মতো করে তাদের
ডাকতে থাকে। এ
সময় রাফি তাড়াহুড়ো করে উঠে এলেও
মাহি পানির নিচের
লোকটির সঙ্গে থেকে
যায়। পরে ডুবুরি এসে পানির নিচে
গিয়ে একটি ঘর
দেখতে পায়। মাহি
তখন সেখানে খেলা করছিল। সেই ঘরের মধ্য
থেকে এক বুড়ি
তাকে এক ঘণ্টা
পরে শিশুটিকে নিতে আসার
জন্য বলে। কথামতো এক ঘণ্টা পর
ওই ডুবুরি আবার পানির
নিচে গিয়ে শিশুটির মৃতদেহ দেখতে পায়।
কিন্তু বুড়ি সেই
মৃতদেহ ডুবুরিকে ফেরত দিতে
চায়নি। তাদের সঙ্গে
জোরাজুরি করে মৃতদেহ আনতে গিয়ে উদ্ধারকারী ডুবুরি রক্তাক্ত জখম হয়।
এলাকাবাসী জানিয়েছে, গত ক’বছর ধরে
পুকুরটি সেচার চেষ্টা করা হলেও এ
পর্যন্ত তা সম্ভব
হয়নি। কারণ পাম্প
বসিয়ে দিনরাত পকুরটি সেচলেও পরদিন সকালে
সেটি আবার পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যায়।’
পুরো
রিপোর্টটি পড়ে তার
গা শিউরে ওঠে।
ওরে বাব্বা! এও কি
সম্ভব?
গা
শিউরে উঠলেও তার
বিশ্বাস করতে কষ্ট
হয়। কারণ বড়মামা বলেছেন, পৃথিবীতে এমন সব
আজগুবি খবর প্রচার হয়, হাজার হাজার
মানুষ বিশ্বাস করলেও বাস্তবের সঙ্গে যার কোনো
মিল নেই। শাওন
চিন্তা করতে লাগল
কী করা যায়।
মানিকনগর জায়গাটা শাওনদের বাসা থেকে
খুব বেশি দূরে
নয়। সে চিন্তা করল সেখানে গেলে হয়তো
বোঝা যাবে ঘটনাটা কতটুকু সত্যি।
পরদিন
খুব ভোরে ছোটমামাকে নিয়ে মানিকনগরের দিকে রওনা
হল সে। পুকুরটির কাছাকাছি পৌঁছার আগেই সে
দেখতে পেল একদল
লোক জটলা করে
পুকুর নিয়ে কী
সব আলাপ করছে।
তাদের সবার পরনেই
লুঙ্গি-পাঞ্জাবি বা পাজামা-পাঞ্জাবি। শাওন আর
তার মামা জটলার
কাছে গিয়ে দাঁড়াল। জটলার একজন বলছে,
আরে ভাই বলবেন
না, এই পুকুরটি হচ্ছে এক রাক্ষুসে পুকুর। আমি পঁচিশ
বছর ধরে এই
এলাকায় থাকি। প্রতিবছরই পুকুরটি একটি ফুটফুটে শিশুকে নিয়ে নেবে।
আমি তো আমার
ছেলেদের বলে দিয়েছি, তোমরা এর পাড়
দিয়েও হাঁটবে না কোনো
দিন।
আরেকজন বলল, আমি তো
প্রতিদিন এই পুকুরে গোসল করি। এ
আমি অনেক আগে
থেকেই জানি। পরশু
আমি নিজের চোখে
দেখেছি, কত সুন্দর একটি ছেলেকে পুকুরটি গিলে ফেলল।
শাওন
এই লোকটির কথা শুনে
বেশ আকৃষ্ট হল। সে
যাকে খুঁজছে এই লোকটিই হয়তো সে।
শাওন
বলল, আঙ্কেল কিছু মনে
করবেন না। আপনারা যে ব্যাপারটি নিয়ে আলাপ
করছেন আমরা এসেছি
সে ব্যাপারে জানার জন্য।
আপনারা কেউ কি
নিজের চোখে দেখেছেন যে পুকুরে পানির মধ্যে
ঘরবাড়ি আছে? আর
সেখানে এক বুড়ি
থাকে?
না
না, তা কি
আর সম্ভব? ওখানে
গেলে যদি কোনো
অসুবিধা হয়ে যায়?
শাওন
অনেকটা হতাশ হল।
তারা আবার হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে পুকুরটির একেবারে কাছে চলে
গেল তারা। পুকুরটির উত্তর ও পূর্বদিকে পুরনো আমলের বাঁধানো দুটি ঘাটলা। মানিকনগর মেইন রাস্তার পাশেই পুকুরটি। শাওন আর
তার ছোটমামা পুকুরের একদম পাড়ে
গিয়ে দাঁড়াল। বেশ নোংরা
পানি হলেও কয়েকজন লোক সেখানে গোসল করছিল। শাওন খেয়াল করল,
অনেক লোক গোসল
করলেও কেউ পাড়
ছেড়ে ভেতরে যাচ্ছে না। তার মানে
পরশুর ঘটনার পর
সবাই হয়তো ভয়ে
ভয়ে আছে।
এক
লোক গোসল সেরে
পাড়ে উঠে গামছা
দিয়ে গা মুছছিল। শাওন তার কাছে
গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ভাই,
আপনি এই পুকরে
কতদিন ধরে গোসল
করছেন?
ক্যান,
অনেক দিন, অনেক
বচ্ছর।
শুনলাম এই পুকুরের পানির নিচে
নাকি ঘরবাড়ি আছে! আপনি
কোনো দিন দেখেছেন?
না
দেখি নাই, তয়
থাকলেও থকতে পারে।
এই দুনিয়ায় তো কত
কিছুই থাকে, যার
খবর আমরা রাখি
না।
আপনি
কোনো দিন পুকুরের মাঝখানে পানির নিচে
যাননি?
তা
গেছি। অন্যসব পোলাপানের লগে পাল্লা দিয়া পানির নিচ
দিয়া কত্তো প্যাঁক তুলছি!
বলেন
কী? তখন আপনি
কোনো ঘরবাড়ি দেখেননি?
না,
তা দেহি নাই।
আপনি
কি বিশ্বাস করেন এই
পুকুরের তলায় এমন
কিছু আছে?
লোকটা
আমতা আমতা করতে
লাগল। অর্থাত্ সে বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস কোনোটাই করতে সাহস
পাচ্ছে না। কারণ
সে এই পুকুরের পানির নিচে অনেক
গেছে কিন্তু কখনও কিছু
দেখতে পায়নি। তাই তার
বিশ্বাস করার কোনো
কারণ নেই। আবার
সবাই যেভাবে বলাবলি করছে তাতে
অবিশ্বাস করার সাহসও
পাচ্ছে না। যদি
সত্যি সত্যি অদৃশ্য কোনো শক্তি থেকে
থাকে! আর তাতে
তার কোনো ক্ষতি
হয়!
শাওন
বুঝল এদের সঙ্গে
কথা বলে লাভ
হবে না। তারা
চিন্তা করল যাদের
ছেলে মারা গেছে
তাদের কাছে গিয়ে
দেখা যাক কোনো
খবর বের হয়
কি না।
এলাকার লোকজনের সাহায্য নিয়ে তারা
দুজন কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই শিশুটির বাসায় গেল। বাসাটি ছিল মৃত্যুপুরীর মতো, যদিও
লোকজন গিজগিজ করছে। বাসার
লোকজন যখন শুনল
তাদের ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে তার
বয়সী দুটো ছেলে
এসেছে খবর জানতে,
তখন তারা শাওন
আর তার ছোটমামাকে খুবই আদর করল।
শাওন
জানতে চাইল, পত্রিকায় যা পড়েছে তা
কতটুকু সত্য, মানে
আসলেই ওই পুকুরের তলায় ঘরবাড়ি বা অন্য
কিছু আছে কি
না।
বাড়ির
লোকজন জানাল, তারা
আসলেও এ ব্যাপারে কিছুই জানে না।
এলাকার লোকজনের কাছে তারা
এ কথা শুনেছে।
সেখান
থেকে বেরিয়ে শাওনরা চিন্তা করল, বেঁচে
যাওয়া ছেলেটির কাছে গেলে
হয়তো কোনো তথ্য
মিলতে পারে। একটু
খোঁজাখুঁজি করে সেই
ছেলেটিকেও পাওয়া গেল।
বন্ধুর মৃত্যুতে তার অবস্থা একেবারেই কাবু। তার
ওপর নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে
বেঁচে আসায় আর
লোকজনের মুখে পুকুরটি সম্বন্ধে নানান কাহিনী শুনতে শুনতে সে
একেবারেই কুঁকড়ে আছে।
ছেলেটি জানাল, তারা দুজন
একসঙ্গে পুকুরে নামে এবং
একসঙ্গে ডুব দিয়ে
পানির নিচে যায়।
সেখানে শক্তমতো কিছু একটা
তার পায়ে ঠেকলে
সে তাড়াতাড়ি সাঁতরে উপরে উঠে
আসে। সেই শক্ত
কিছুর আঘাতে তার
পায়ের খানিকটা অংশ কেটেও
যায়। তার বন্ধু
দীর্ঘ সময় ফিরে
না এলে সে
লোকজনকে খবর দেয়।
লোকজন এসে ডুবুরি নামিয়ে তাকে উদ্ধা
করে।
আবারও
হতাশ হয় শাওন।
এবার সে ভাবল,
সেই ডুবুরির কাছেই যেতে
হবে। তাহলে যদি
সত্যি ঘটনা জানা
যায়।
ডুবুরিকে পেতে তাদের অনেক
কষ্ট হল। ফায়ার
সার্ভিস অফিসে যোগাযোগ করে তাদের কাছ
থেকে ফোন নম্বর
নিয়ে অবশেষে সেই ডুবুরিকে ফোনে পাওয়া গেল।
সব
ঘটনা শুনে ডুবুরি বলল, আরে কোথায়
পানির নিচে ঘরবাড়ি আর কোথায় লোকজন!
আসলে বড় একটি
গাছের মুড়ো পুকুরের তলায় পড়ে রয়েছে। শিশুটির পরনের কাপড়
সেটির সঙ্গে পেঁচিয়ে গিয়েছিল। আর তাই
সে আর উপরে
উঠতে পারেনি। আর তাকে
ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে
সেই গাছের মুড়োর
আঘাতে আমার শরীরের কিছু অংশ ছিঁড়ে
গিয়েছিল।
সপ্তাহখানেক পরে আরেক দিন
সকালে শাওন আর
তার ছোটমামা আবার হাঁটতে হাঁটতে সেই পুকুরটির পাড়ে গেল। দেখল
সেই পুকুরটি পুরোপুরি সেচে ফেলা
হয়েছে। পুকুরের ঠিক মাঝখানে বেশ বড় একটা
গাছের গুঁড়ি পড়ে
আছে। এলাকর লোকজন
জানাল, পাঁচটি শ্যালো মেশিন দিয়ে
খুব তাড়াতাড়ি পকুরটি সেচে ফেলা
হয়েছে। তাদের ধারণা,
এর আগে যারা
মারা গেছে তারা
সবাই ওই গাছের
গুঁড়িটার সঙ্গে আটকে
গিয়ে আর উপরে
উঠতে পারেনি। পুকুরটিতে আর ছিল
বড় একটি গর্তের মতো, যেটি দিয়ে
প্রচুর পানি পুকুরটিতে আসার সুযোগ ছিল।
এর আগে একটি
শ্যালো মেশিন দিয়ে
যে পরিমাণ পানি পুকুর
থেকে বের করে
দিত, সারা রাত
ধরে ওই গর্তটি দিয়ে পানি এসে
তা আবার পূরণ
হয়ে যেত।
শাওন
আর তার ছোটমামা ফিরতে ফিরতে ভাবল,
আসলে এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই মানুষ
বিশ্বাস করে, যার
সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল
থাকে না।
নয়াদিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত
আরও
গল্প এখানে
http://adroitbd1.blogspot.com/
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন