সূত্র উল্লেখপূর্বক এই ব্লগের যে কোনো লেখা যে কোনো জায়গায় উদ্ধৃত করা যাবে। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের অনুমতি নিতে হবে।

সোমবার, ৪ জুন, ২০১২

ছয় ঋতুর দেশ


পরীদের রাজ্যে বাংলাদেশ নামে একটি দেশের নাম সবার মুখে মুখে। সে দেশে দিগন্তজোড়া ফসলের ক্ষেত। সেই সবুজের বুক চিড়ে বয়ে গেছে রুপোলি নদী। সে নদীতে ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়ায় রুপোলি ইলিশ ছাড়াও আরও কতো কতো মাছ। বনে পাহাড়ে বাস করে নানা ধরনের জীবজন্তু। গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলি। সবকিছুই পরীদের আকর্ষণ করে।
কিন্তু হলে কী হবে, পরীদের রানীর অনুমতি ছাড়া কেউ সে দেশে যেতে পারে না। পরীদের রানীর নাম লাল পরি। তার ছয় কন্যা। বেগুনী পরী, নীল পরী, আসমানী পরী, সবুজ পরী, হলুদ পরী আর কমলা পরী। এই ছয় পরীরও দেশটি দেখার খুব শখ।
একদিন ছয় পরী মিলে গেলো লাল পরীর কাছে। লাল পরীকে তারা বললো, আমরা বাংলাদেশ দেখতে যাবো।
লাল পরী বললো, যেতে পারো, তবে সবাই একসঙ্গে যেতে পারবে না। যেতে হবে একজন একজন করে। আর ফিরে এসে সে দেশের গল্প শোনাতে হবে আমাকে।
ছয় বোন রাজি হয়ে গেলো।
প্রথমে এলো বেগুনী পরীর পালা। বেগুনী পরীর আনন্দ আর ধরে না। নির্দিষ্ট দিনে বেগুনী পরী সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলো সুন্দর সেই দেশ দেখতে।
পরীদের দেশ অনেক অনেক দূরে। সেখান থেকে উড়তে উড়তে, উড়তে উড়তে, উড়তে উড়তে বেগুনী পরী চলে এলো তার স্বপ্নের দেশে। ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়ালো। তারপর আবার ফিরে গেলো নিজেদের দেশে।
এভাবে একের পর এক ছয় বোনই ঘুরে গেলো তাদের স্বপ্নের দেশ থেকে।
একদিন লাল পরী সবাইকে ডেকে বললো, তোমরা সবাই তোমাদের স্বপ্নের দেশ দেখে এসেছো। এবার বলো কে কী রকম দেখলে।
বেগুনী পরি বললো, আমি এক আজব দেশ দেখে এসেছি। সে দেশে প্রচণ্ড খরতাপে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। তার মধ্যেই হঠাত্ হঠাত্ ধেয়ে আসে ঝড়। ঝড় উড়িয়ে নেয় মানুষের বাড়িঘর। নদীও ভেঙে নেয় মানুষের ঘরবাড়ি। তবে আশ্চর্য রকম সাহসী সে দেশের মানুষ। এতোসব ঝড়কে তারা একদম পাত্তাই দেয় না। আর একটা সুন্দর জিনিসও দেখেছি আমি। স্বপ্নের সে দেশের গাছে গাছে নানান রকমের সুস্বাদু ফল। আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, আরও মজার কতো ফল!
নীল পরী বললো, আমি এমন এক দেশ দেখে এসেছি, যে দেশের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে থাকে। সেসব মেঘ থেকে ঝরঝর বৃষ্টি ঝরতেই থাকে। সেই বৃষ্টির মধ্যেও কৃষক মাথায় বর্ষাতি বা মাথাল পরে কৃষিকাজ করে। মাঝি নৌকা চালায়। গাছে গাছে কদম-কেয়া ফুল ফুটে থাকে।
নীল পরীর কথা শেষ হলে আসমানী পরী তার গল্প শুরু করে। আমি যে দেশে গেছি সে দেশের আকাশে সারা দিন মেঘেরা খেলা করে। খণ্ড খণ্ড মেঘ ভেসে বেড়ায় আকাশ জুড়ে। নদীর পাড়ে বাতাসে দুলতে থাকে সাদা কাশফুল। সে এক মজার দেশ।
সবুজ পরী বললো, আমি এমন এক দেশে গেছি যেখানে মাঠে মাঠে সোনালী ফসল দোল খায়। কৃষকের মাঝে পড়ে যায় ফসল কাটার ধুম। চারদিকে নতুন ধানের মউ মউ গন্ধ। ঘরে ঘরে চলে নবান্নের উত্সব। সেখানে সকালবেলা শিশির ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে হালকা শীতের ছোঁয়ায় শরীর শিরশির করে ওঠে। নদীতে ভেসে বেড়ায় নানা রঙের পালতোলা নৌকা। মাঝি গান গাইতে গাইতে দাঁড় বাইতে থাকে। সত্যি সে এক অপূর্ব সুন্দর দেশ।
হলুদ পরী বললো, তোমাদের দেখার সঙ্গে আমার দেখা স্বপ্নের দেশের কোনো মিলই নেই। আমি দেখেছি সেখানে প্রচুর শীত পড়ে। কিন্তু সেই শীতের মধ্যেও গ্রামের লোকদের মধ্যে আনন্দের বান ডেকে যায়। তাদের ঘরে গোলা ভরা ফসল। মনে আনন্দের তুফান। বাড়িতে বাড়িতে পিঠা-পুলি-পায়েশ খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। খেজুর গাছে হয় খেজুরের মিষ্টি রস। সে রস দিয়ে তৈরি হয় গুড় আর গুড় দিয়ে হয় পিঠা। সকালের মিষ্টি রোদে বসে সবাই মজা করে পিঠা খায়।
সবশেষে কমলা পরী বললো, আমি যে দেশে গেছি সে সত্যি এক মজার দেশ। সেখানে না আছে গরম, না আছে ঠাণ্ডা, না আছে বৃষ্টিবাদল। ফুলের গন্ধে চারদিক মউ মউ করে। তার ওপর চৈতি হাওয়ায় মন ভরে যায়।
সবার বলা শেষ হলে ছোট্ট সবুজ পরী আবার বললো, আচ্ছা আমরা তো সবাই একটি দেশই দেখার কথা। কিন্তু সবার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমাদের কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। আমরা হয়তো একেক জন একেক দেশে গিয়েছিলাম। ওইটুকু ছোট্ট দেশটির সব জায়গাই তো আমরা ঘুরে ঘুরে দেখেছি। তাহলে একেক জন একক রকম দেশ দেখলাম কী করে?
এবার রানী বললো, না, তোমাদের কোনো ভুলই হয়নি। তোমরা সবাই একই দেশে গিয়েছো এবং সেটা তোমাদের সবার প্রিয় বাংলাদেশই ছিলো। কিন্তু তোমরা একেক জন একেক সময়ে গিয়েছো। তাই একেক জন একেক রকম পরিবেশ দেখেছো।
লাল পরি বলতে লাগলো, আসলে বাংলাদেশ একটি ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ। সে দেশে ছয়টি ঋতু আছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত্, হেমন্ত, শীত বসন্ত-ছয় ঋতুতে প্রকৃতির পরিবেশ থাকে ছয় রকম। তোমরা ছয়জন গিয়েছো ছয় ঋতুতে। যেমন বেগুনী পরী যখন গেছে তখন ছিল গ্রীষ্মকাল, তাই তখন বেশ গরম দেখেছে। এমনিভাবে আসমানী পরী শরত্কালে সেখানকার আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ আর নদীতীরে সাদা কাশফুল দেখেছে। সবুজ পরী হেমন্তকালে, হলুদ পরী শীতকালে আর কমলা পরী বসন্তকালে সেখানে গিয়েছিলে।
লাল পরীর কথা শুনে সবাই নিজেদের ভুল বুঝতে পারল।